নায়ক তিনি, তিনিই ভিলেন

১৯৯৬ এর শেষের দিক। তখন জিম্বাবুয়ে সফরে পাকিস্তান দল। হঠাৎ করেই সিরিজের মাঝ পথে অবসরের ঘোষণা দিলেন পাকিস্তানি উইকেটরক্ষক রশিদ লতিফ। এমনকি দেশে ফিরেও গেলেন! ফাঁস করলেন গোমরও! জানালেন তৎকালীন পাকিস্তান অধিনায়ক সেলিম মালিক ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িয়েছেন।

১৯৯৬ এর শেষের দিক। তখন জিম্বাবুয়ে সফরে পাকিস্তান দল। হঠাৎ করেই সিরিজের মাঝ পথে অবসরের ঘোষণা দিলেন পাকিস্তানি উইকেটরক্ষক রশিদ লতিফ। এমনকি দেশে ফিরেও গেলেন! ফাঁস করলেন গোমরও! জানালেন তৎকালীন পাকিস্তান অধিনায়ক সেলিম মালিক ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িয়েছেন। এমনকি রশিদকেও তিনি অর্থের বিনিময়ে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই খবরে তোলপাড় পাকিস্তানসহ ক্রিকেট বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে!

ফিক্সিং প্রস্তাব শুধু ফিরিয়েই দেননি, বরং এর প্রতিবাদেই ক্ষোভে অবসরের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন লতিফ। অধিনায়ক সেলিম মালিক অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেন! রশিদ লতিফের ভাষ্যমতে, ফিক্সিংয়ের সাথে ওয়াসিম আকরামসহ আরো বেশ কয়েক ক্রিকেটারও জড়িত ছিলেন। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) থেকে জরুরি ভিত্তিতে একটা তদন্ত কমিটি গঠনও হলো। আইনগতভাবে এই তদন্ত চলাকালীন অবশ্য দিব্যি খেলে গেছেন সেলিমসহ বাকিরা। রশিদের মূল অভিযোগের তীরটা ছিল সেলিমের দিকেই।

অবশ্য তদন্ত কমিটির রিপোর্টে প্রায় বছর কয়েক পর এই অভিযোগ প্রমাণিতও হয়! আর সেলিম মালিককে আজীবন নিষিদ্ধও করা হয়। রশিদ লতিফের মতে, তিনি ফিক্সিং কিংবা অন্যায়ের সাথে কখনোই আপোষ করেননি করবেনও না। দেশের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারবেন না, বিধায় ক্যারিয়ার শুরুর ২-৩ বছরের মাথায়ই ঘোষণা দিয়ে ফেলেন অবসরের।

এরপর দু’বছরের মাথায় আবারো হুট করেই দলে ফেরেন রশিদ! সেবার স্বাধীনতা কাপের ফাইনালে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তান, এতে অধিনায়কত্ব থেকে বরখাস্ত হন ওয়াসিম আকরাম। আর নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান রশিদ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসেই ব্যাট হাতে আউট হন শূন্য রানে! সেই সাথে গড়লেন লজ্জার রেকর্ডও! অধিনায়ক হিসেবে মার্ক টেলরের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসেই ডাকের রেকর্ডে নাম লেখান রশিদ!

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট জয় দিয়ে অধিনায়ক হিসেবে প্রথম জয়ের দেখা পান তিনি। এরপর ত্রিদেশীয় সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ফাইনালে হারের পর শুধু অধিনায়কত্বই নয় দল থেকেই বাদ পড়েন রশিদ! পরের তিন বছর আর জাতীয় দলের আঙ্গিনায় পা রাখতে পারেননি তিনি। ক্যারিয়ারে এক প্রকার অনিশ্চয়তায়ই ছিলেন তিনি। অভিষেকের কয়েক বছরের মাঝে ফিক্সিং বিতর্কে নিলেন অবসর। ফেরার পর বাজে ফর্মের কারণে অধিনায়কত্ব হারালেন, সাথে দলে জায়গাটাও!

অবশ্য তিন বছর বাদে ২০০১ সালে আবারো দলে ফেরেন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দেখা পান টেস্ট ক্যারিয়ারের একমাত্র সেঞ্চুরি। উইকেটের পেছনে তিনি ছিলেন বরাবরই দুর্দান্ত। কামব্যাকের পর ব্যাট হাতে যেমন ফর্মে ছিলেন, তেমনি উইকেটের পেছনেও ছিলেন সময়ের অন্যতম সেরাদের একজন। টানা পারফর্মের পর আবারো অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি!

২০০৩ সালে পাকিস্তান সফরে তখন বাংলাদেশ। সে সময়ে বাংলাদেশ দলের অবস্থা ছিল এমন যে, সর্বশেষ ২০ ম্যাচের ১৯ টেস্টেই হেরেছে! খর্ব শক্তির বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় পাওয়াটা তখন পাকিস্তানের জন্য কঠিন কিছু না। প্রথম দুই টেস্টেই করাচি এবং পেশোয়ারে আধিপত্য দেখিয়ে জয় পায় পাকিস্তান। শেষ টেস্টে মুলতানে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ! এর মাঝে দ্বিতীয় ইনিংসে অলক কাপালির ব্যাটে এজ হয়ে উইকেটের পেছনে রশিদ লতিফের হাতে যায় বল।

রশিদ লতিফের হাত থেকে বল মাটিতে বাউন্স খাওয়ার পর তিনি ক্যাচটি ধরেন! বল ড্রপ করার পর ক্যাচ ধরলেও এমন ভঙ্গিমায় ছিলেন যে এটি স্পষ্ট আউট। অবশ্য উইকেটের পেছনে ক্যাচ ধরার সময় লতিফের বডি এমনভাবে ছিল খালি চোখে আম্পায়ারও খেয়াল করেননি ক্যাচ ড্রপ হয়েছিল!

আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে ক্যাচ আউটের শিকার হয়ে ফেরেন কাপালি। পরবর্তীতে ম্যাচ শেষে ভিডিও ক্লিপ দেখে রশিদকে কয়েক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করেন ম্যাচ রেফারি মাইক প্রক্টর। ওই ম্যাচে মাত্র ১ উইকেটে হেরে যায় বাংলাদেশ। মুলতান টেস্টে রশিদ লতিফের এমন ঘৃণ্য কান্ডে অবশ্য ক্ষোভ ঝেড়েছিল বাংলাদেশী ক্রিকেট সমর্থকরা। জয়ের কাছে গিয়েও মুলতান টেস্টে হেরে বসে সফরকারী বাংলাদেশ। সেদিন রশিদ লতিফ এমন ঘৃণ্য ঘটনা না ঘটালে কে জানে, হয়তো বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক জয়ের দেখা পেত।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠানো রশিদ লতিফই কিনা ভুয়া উইকেটের নাটক করলেন! আর সেটিই ছিল রশিদের ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। এরপর আর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি তিনি। এক ক্যাচেই কিনা ক্যারিয়ার শেষ রশিদের!

জন্ম পাকিস্তানের করাচিতে। ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল মালিত কমপ্যানিয়ন ক্লাব থেকে। শুরুর দিকে ব্যক্তিগত কোনো গ্লভসও ছিল না তাঁর। ক্লাব থেকে দেওয়া গ্লভস নিয়েই খেলতেন। ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেডের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করেই ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় দলে। তবে, ১৯৯২ এর বিশ্বকাপের দৌঁড়ে মঈন খানের সাথে পেরে ওঠেননি তিনি। বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ড সফরে পেয়েছিলেন সুযোগ।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ। আর অভিষেক টেস্টেই করেন মেইডেন ফিফটি। ওই সফরেই অভিষিক্ত হন ওয়ানডেতেও। পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই প্রতিযোগিতায় ছিলেন আরেক উইকেটরক্ষক মঈন খানের সাথে। যদিও মঈন খানই সুযোগটা পেয়েছিলেন বেশি। ফিক্সিং বিতর্ক নিয়ে মাঝের বেশ কিছু সময় তো দলেই ছিলেন না রশিদ। অবশ্য পাকিস্তান ক্রিকেটের সেরা উইকেটরক্ষক কে’এ নিয়েও আছে দ্বি-মত। কারো মতে মঈন খান, আবার কারো মতে রশিদ লতিফ!

তবে, অধিকাংশের মতে রশিদ লতিফই ছিলেন উইকেটের পেছনে সেরা। টেস্টে ১১৯ ক্যাচ আর ১১ টি স্টাম্পিং করেছেন তিনি। এছাড়া ওয়ানডেতে ১৮২টি ক্যাচের পাশাপাশি আছে ৩৮ স্টাম্পিং। ইনিংস প্রতি ডিসমিশাল হিসেব করলে টেস্টে রশিদ লতিফ ১.৮৮ ও ওয়ানডেতে ইনিংস প্রতি ১.৩৪ টি ডিসমিশাল করেছেন! যা পাকিস্তানের হয়ে ওয়ানডেতে সেরা এবং টেস্টে আছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। তাঁর সময়ের বিশ্বের সেরা তিন উইকেটকিপারের একজন ভাবা হতো রশিদকে।

ব্যাটিংটায় অবশ্য ছিলেন খানিকটা পিছিয়ে। মাত্র ৩৭ টেস্ট খেলা রশিদ ২৯ গড়ে করেছেন প্রায় ১৪০০ রান। অপরদিকে, ১৬৬ ওয়ানডেতে ১৯ গড়ে করেছেন ১৭০৯ রান। টেস্টে ৭ ফিফটির সাথে আছে ১ সেঞ্চুরি! অপরদিকে, রঙিন পোশাকে লম্বা ক্যারিয়ারে করেছেন মোটে তিন ফিফটি।

ফিক্সিং নিয়ে ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আওয়াজ তুলছেন রশিদ লতিফ। ফিক্সিংয়ের বিরুদ্ধে তিনি সদা সোচ্চার একজন। কিন্তু, মুলতান টেস্টের সেই ‘ড্রপ ক্যাচ’ কাণ্ডের কারণে অনেক ক্রিকেট ভক্তের কাছেই ভিলেন বলে গিয়েছিলেন তিনি। অন্যায়ের প্রতিবাদকারী খোদ নিজেই কি’না ম্যাচ জিততে করলেন ছলনা!

তবে, উইকেটরক্ষক হিসেবে পাকিস্তানের ইতিহাসে তিনি তর্ক-সাপেক্ষে সেরা একজন সেটা নিয়ে সংশয় নেই। ফিক্সিং বিতর্ক আর উইকেট কিপিং নিয়ে আলোচনা হলেও রশিদের ব্যাটিং নিয়ে আলোচনাটা হয়েছে বেশ কমই। এত কিছুর পরেও লম্বা ক্যারিয়ার গড়া রশিদ কি ব্যাটিংয়ে আদৌ নিজের সেরাটা দিতে পেরেছিলেন?!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link