প্রতিটা গোলের পর গ্যালারিতে প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্নর কম। কখনও আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করেন সমর্থকরা। আবার কখনও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান সকলে। কখনও আবার সমতায় ফেরার স্বস্তির নিঃশ্বাস শোনা যায়। প্রতিটা গোল যেন মানব জীবনেরই গল্প শুনিয়ে যায়।
সার্বিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিল যেন সেই জীবনেরই প্রতিচ্ছবি দেখায়। গোল শূন্য প্রথমার্ধ শেষে দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম গোলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন ব্রাজিল সমর্থকরা। আর রিচার্লিসনের দ্বিতীয় গোলটা যেন ছিল স্রেফ অবিশ্বাস্য! তাঁর বাইসাইকেল কিক জালে জড়ানোর পর অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল গোটা গ্যালারি। বিশ্বকাপের মঞ্চে ব্রাজিলের শুরুটা হল তাই রাজার বেশেই।
গত তিন বছরে মাত্র একটা হার। আঠারো মাস ধরে অপরাজিত। অসাধারণ আক্রমণভাগ। ব্রাজিলের এবারের দলটার হেক্সা জিততে পারার পেছনে নানা যুক্তিই দাঁড় করানো যায়। তবুও কোথাও যেন একটা খামতি ছিল। প্রথম ম্যাচেই ফর্মে থাকা সার্বিয়াকে উড়িয়ে দিয়ে সব অবিশ্বাসের জবাব যেন দিয়ে দিলেন নেইমার-ভিনিসিয়াসরা। এক লহমায় যেন বদলে গেল বিশ্বকাপের চালচিত্র।
বাঁ প্রান্তে গতি আর ড্রিবলিংয়ে ঝড় তুলেছেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা ভিনিসিয়াস জুনিয়র। তাঁকে সামলাতে হিমশিম খেয়েছেন দীর্ঘদেহী সার্বিয়ান ডিফেন্ডাররা। প্রথমার্ধে গোটা কয়েক ক্রসও বাড়িয়েছিলেন নাম্বার নাইন রিচার্লিসনের উদ্দেশ্য, কিন্তু বেশির ভাগই ফিরিয়েছেন ডিফেন্ডাররা নয়তো রিচার্লিসন পাঠিয়েছেন গ্যালারিতে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে আর ফেরানো যায়নি, ৬২ মিনিটে ভিনিসিয়াসের ডানপায়ের জোরালো শটটা কিপার ফিরিয়েছিলেন বটে, কিন্তু কপাল মন্দ।
বলটা গিয়ে পড়ে রিচার্লিসনের পায়ে, সামনে খালি পোস্ট পেয়ে তিনি কি আর ভুলটা করেন! এরপরের গোলটা তো আরও চোখ ধাঁধানো। ভিনিসিয়াসের আউট সাইডার বুট ক্রসটা খানিকটা সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল রিচার। তিনি তাই চেষ্টা করলেন বলের গতিপথটা খানিকটা পরিবর্তন করার। পা দিয়ে বলটাকে থামিয়ে শূন্যে থাকা অবস্থাতেই শরীরটাকে ছুঁড়ে দিয়ে জোরালো এক বাইসাইকেল কিক নিলেন। কিপার ভানজা মিলিঙ্কোভিচ স্যাভিচ ড্রাইভ দিয়েও বলের নাগাল ছুঁতে পারলেন না। ব্রাজিল সমর্থকদের চিৎকারে স্টেডিয়ামে তখন কান পাতা দায়।
অথচ বিশ্বকাপ শুরুর মাস দেড়েক আগেও ব্রাজিল দলের সবচেয়ে দুর্বলতম সদস্য ভাবা হচ্ছিল রিচার্লিসনকে। শোনা যাচ্ছিল হাতে পর্যাপ্ত নাম্বার নাইন না থাকায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাঁকে দলে রেখেছেন সেলেসাও কোচ তিতে। অবশ্য রিচা নিজেও প্রথাগত নাম্বার নাইন নন। বিশ্বকাপ শুরু হতেই অবশ্য সব প্রশ্নের জবাব তিনি দিয়ে দিয়েছেন মাঠের খেলাতে।
নেইমার নি:সন্দেহে এখনও ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় তারকা, সমর্থকদের নয়নের মণি। দর্শকরা এখনও মাঠে আসেন নেইমারকে দেখতে। গতি, ড্রিবলিং দিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার পাশাপাশি ব্রাজিলের আক্রমণটা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনিই। বাঁ প্রান্তে রয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের ভবিষ্যৎ ভিনিসিয়াস জুনিয়র, এর মাঝেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে জয়সূচক গোল করা হয়ে গিয়েছে এই তারকার। ডানপ্রান্তটা সামলানোর দায়িত্ব বর্তেছে রাফিনহার উপর। দেনার দায়ে থাকা সত্ত্বেও বার্সেলোনা যাকে দলে ভিড়িয়েছে বড় আশা নিয়েই।
ব্রাজিলের বেঞ্চেও বড় বড় সব নাম। এই মৌসুমেই ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে আয়াক্স থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আসা অ্যান্থনি রয়েছেন বেঞ্চে। রয়েছেন আর্সেনালের দুই তারকা গ্যাব্রিয়েল জেসুস এবং গ্যাব্রিয়েল মার্টিনেল্লি। মৌসুমের শুরু থেকেই এই দুজন আছেন দুরন্ত ফর্মে, তাঁদের উপর ভর করেই আর্সেনাল আছে ইপিএলের শীর্ষে। রিয়াল মাদ্রিদের রদ্রিগো সার্বিয়ার বিপক্ষে বদলি হিসেবে নেমে দেখিয়েছেন তিনিও সুযোগ পেলে ভয়ংকর হয়ে উঠতে জানেন। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড কিংবা স্পেনকে ছাপিয়ে বিশ্বকাপের সেরা আক্রমণভাগ তাই ব্রাজিলেরই।
ব্রাজিলের মিডফিল্ডটা সামলাবেন অভিজ্ঞ কাসেমিরো, রক্ষণে অভিজ্ঞ থিয়াগো সিলভার সাথে জুটি বাঁধবেন মার্কুইনহোস। আর গোলবারের নিচে আছেন বর্তমানে বিশ্বের সেরা কিপার অ্যালিসন বেকার।
সার্বিয়ার বিপক্ষে শেষ ২০ মিনিটে ব্রাজিল দেখিয়েছে দল হিসেবে কতটা ভয়ংকর তাঁরা। কাতার বিশ্বকাপে তাই শিরোপা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাবনা নেই ব্রাজিল শিবিরে। সমর্থকরাও তাই সুদূর লাতিন মুলুক থেকে উড়ে এসেছেন মরুর দেশ কাতারে, মাতিয়ে রাখছেন গ্যালারি। লুসাইলে ব্রাজিল যেটা দেখিয়েছে, সেটা কেবলই শুরু। যত দিন গড়াবে, এই ব্রাজিল তত ভয়ংকর হয়ে উঠবে। অবশেষে বিশ্বকাপের ‘আসল রাজা’ এসে পৌঁছেছে।