১৪ বারের অংশগ্রহণে ১০ বারই ফাইনাল! আইপিএলের মতো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ টুর্নামেন্টে একটা ফ্রাঞ্চাইজির এমন দাপুটে পরিসংখ্যানে অবাক না হয়ে উপায় কই! তবে বিস্ময়, অভাবনীয় বলয় ভেঙ্গে চেন্নাই সুপার কিংস ঠিক সেটাই করে দেখিয়েছে। আরেকটা মৌসুম, আরেকবার ফাইনালের মঞ্চ তাদের বরণ করে নিতে প্রস্তুত। ২০২১ এর পর আবারো শিরোপা জয়ের হাতছাতি চেন্নাইয়ের সামনে।
অথচ এবারের মৌসুমে চেন্নাইয়ের শুরুটা কতই না অনিশ্চয়তায় ঘেরা ছিল! বেন স্টোকসের পিছনে সাড়ে ষোল কোটি রূপি খরচা দলটার। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর আগে জানা গেল, বেন স্টোকস খেলতে পারলেও, বোলিংটা করতে পারবেন না। এখানেই শেষ নয়। কিউই পেসার কাইল জেমিসন ইনজুরির কারণে ছিটকে গেলেন পুরো আইপিএল আসর থেকে। তাঁর সাথে ইনজুরির মিছিলে যোগ দিলেন দীপক চাহারও।
এ তো গেল ‘ইনজুরি’ নামক দুর্ভাগ্যের কথা। বেশ কয়েক মৌসুম ধরেই, চেন্নাইয়ের ব্যাটিং লাইনআপে অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছিলেন আম্বাতি রাইডু। কিন্তু এবারের মৌসুমে এসেই ছন্দ হারিয়ে ফেললেন এ ব্যাটার। এমন ইনজুরি আক্রান্ত স্কোয়াড, ফর্মহীন ব্যাটারদের নিয়ে নতুন করে গুছিয়ে উঠতে পারাটাই তখন চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। কিন্তু অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি সেই চ্যালেঞ্জটা নিলেন। সবাইকে একসূত্রে গেঁথে আবারো দলটার চেহারা বদলে ফেললেন। সবাইকে ভাবতে বাধ্য করলেন, আত্মবিশ্বাস নামক অস্ত্র থাকলেই ফিরে আসা সম্ভব। বড় কিছুর পথে পা বাড়ানো তখন হয়ে ওঠে আরো সুমসৃণ।
চেন্নাই সুপার কিংসের এবারের দলটা এরপর থেকেই বদলে গেল। আনকোরা পেসারদের দিয়েই বোলিং ইউনিটে লড়াইটা জিইয়ে রাখলেন ধোনি। শুরুতেই সফলতা মিলবে না, এটা অনুমেয়ই ছিল। তবে ধোনির বার্তা ছিল স্পষ্ট, ফলাফল যায়-ই হোক, খেলোয়াড়দের উপর তাঁর আস্থা থাকছে শেষ পর্যন্ত। এজন্য ম্যাচের পর ম্যাচে বল হাতে খরুচে থাকার পরও তিনি তুষার দেশপাণ্ডেকে সুযোগ দিয়ে গিয়েছেন।
আর সেই সুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশপাণ্ডে পরবর্তীতে আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেন। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রতিপক্ষের উইকেট নিয়ে দলকে ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন প্রায় ম্যাচেই। মাথিশা পাথিরান, মাহিশ থিকশানা— এই দুই লঙ্কান বোলার আবার পুরো আসর জুড়েই ধোনির বাজির ঘোড়া হয়ে ছিল। একজন পেস বোলিং দিয়ে নজর কেড়েছেন, আরেকজন অফস্পিনের বিষ ঢেলে প্রতিপক্ষকে কাবু করেছেন পুরো আসর জুড়েই। লঙ্কান এ দুই পেসার সময়ে সাথে এবারার আইপিএলে চেন্নাইয়ের বোলিং লাইনআপে হয়ে উঠেছিলেন রীতিমত সর্বেসবা।
কিউই ব্যাটার ডেভন কনওয়ে শুরুতে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। রান পাচ্ছিলেন টুকটাক, কিন্তু দলের জন্য তা সুফল বয়ে আনছিল না। তবে কিউই এ ব্যাটারের উপর ঠিকই ভরসা রেখেছিল চেন্নাইয়ের টিম ম্যানেজমেন্ট। আর সেই ভরসার মূল্য কনওয়ে পরবর্তীতে দিয়েছেন দুর্দান্তভাবে।
শিভাম দুবে, ভারতের ক্রিকেটে অপরিচিত নাম নয়। তারপরও শেষ বেশ কয়েকটা মৌসুমে চোখে পড়ার মতো কিছু করতে পারছিলেন না। চেন্নাইয়ের হয়ে এবার এ ব্যাটার জাত চিনিয়েছেন একদম মোক্ষম সময়ে। আম্বাতি রাইডু ক্রমাগত মিডল অর্ডারে ফ্লপ হচ্ছিলেন। আর ঠিক তখনই দলের হয়ে হাল ধরেন দুবে। বলতে গেলে, পুরো মৌসুম জুড়ে চেন্নাইয়ের মিডল অর্ডার একাই টেনেছেন এ বাঁহাতি ব্যাটার। প্রায় ১৬০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করে যেমন দ্রুত গতিতে রান তুলেছেন, ঠিক তেমনি দলের প্রয়োজনে ধারাবাহিকভাবে কার্যকরী সব ইনিংস খেলেছেন।
রবীন্দ্র জাদেজার জন্য গতবারে আইপিএল এক প্রকার দুঃস্বপ্নেই ঘেরা ছিল। নেতৃত্ব পেয়েছিলেন। কাজে লাগাতে পারেননি। পরে অধিনায়কত্ব থেকে অব্যাহতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ইনজুরিতে ঐ আইপিএলটার অর্ধেক অংশই খেলতে পারেননি। তাই এবারের আইপিএল জাদেজার জন্য এক ধরনের ফেরার মঞ্চই ছিল। জাদেজা চেন্নাইয়ের হয়ে অবশেষে স্বরূপে ফিরেছেন। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং- অলরাউন্ডিং পারফর্ম্যান্স দিয়ে ঠিকই এবারের আসরে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। আর সেই ধারাবাহিকতায় দলও বদলে গিয়েছে। ২০২১ এর পর আবারো তাঁর দল ফাইনালে।
চেন্নাইয়ের এ সাফল্য যাত্রায় আরেকটা ফ্যাক্টর হলো, ‘ধোনি ফ্যাক্টর’। ব্যাট হাতে প্রতি ম্যাচেই শেষ দিকে নেমেছেন। রানও খুব বেশি করতে পারেননি। কিন্তু ব্যাট হাতে শেষদিকে নেমে ঝলকটা ঠিকই দেখিয়েছেন। যে ৩/৪ বল পেয়েছেন, দেখা গিয়েছে, তার মধ্যেই দুটো বলকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বাউন্ডারির ওপারে। তবে ধোনির মূল রোলটা তো আর ব্যাটিং নয়। তাঁর কাছে দলের চাহিদা হলো, নেতৃত্ব। আর সেই নেতৃত্বটা ঠিকঠাকই দিয়েছেন ধোনি।
মৌসুম শুরুর আগেই প্রায় ভঙ্গুর হওয়ার পথের একটা দলকে সাজিয়েছেন নিজের মতো করে। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন যে কোনো পরিস্থিতিতেই। বাইরের সমালোচনার তোয়াক্কা না করে নিজের খেলোয়াড়দের উপর বিশ্বাস রেখেছেন।
আর সেই বিশ্বাসের দৌড়েই চেন্নাই সুপার কিংস এবার ফাইনালের মঞ্চে। দল হিসেবে চেন্নাই সফল, অধিনায়ক হিসেবে ধোনি দুর্দান্ত আর চেন্নাইয়ের স্কোয়াড অনেক সীমাবদ্ধতার ফাঁকফোকর বন্ধ করেছে নিজেদের সেরাটা ঢেলে দিয়ে। এই তিনের মিশেলেই চেন্নাই সুপার কিংসের লক্ষ্যের খেরোখাতায় যুক্ত হয়েছে সাফল্য। কিংসদের সাফল্যের রাজমুকুটে এখন আরেকতা পালক যুক্ত হওয়ার পালা।
আগামী ২৮ মের ফাইনালটা নিজেদের করে নিতে পারলে পঞ্চমবারের শিরোপা জয়ের স্বাদ পাবে চেন্নাই সুপার কিংস। সর্বোচ্চ ফাইনালের কীর্তি আগে থেকেই চেন্নাইয়ের। এবার অপেক্ষা, সর্বোচ্চ আইপিএল শিরোপা জয়ের কীর্তিতে নিজেদের নাম লেখানোর দিকে। ধোনির চেন্নাই এবার সেই লক্ষ্যে ফাইনাল জয়ের মুহূর্ত তৈরি করতে পারবে তো? উত্তরটার জন্য আপাতত আরো কয়েকটা দিনের অপেক্ষা।