রবার্ট ‘লণ্ডভণ্ড’স্কি!

অ্যামাজনের তপ্ত দুপুর, বনের মাঝে বয়ে চলা নদীর তীরে তেষ্টা মেটাতে ব্যস্থ হরিণ কিংবা জেব্রার পাল। খানকিটা দূরে নিরবে, নিভৃতে গাছের আড়ালে অপেক্ষায় এক ক্ষুধার্ত সিংহ। অপেক্ষা ভুল করার, অপেক্ষা দলছুট হবার। নিশানা তৈরি, দৌড়ে গিয়ে ঘাড়ে বসিয়ে দিলো এক কামড়। শিকার কুপোকাত, শিকারীর ভোজনের রাত। এমন দৃশ্য কতই না দেখেছি ডিস্কভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে।

ঠিক ততটা ভয়ংকর না তবে এমন শিকারের দৃশ্য দেখা মেলে ফুটবলের মাঠেও। এমন ধূর্ত শিকারীদের একজন রবার্ট লেভানডস্কি। জার্মান ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ আক্রমণের অবিচ্ছেদ্য অংশ পোলিশ নাম্বার নাইন৷

পরিসংখ্যান ঘাটলেই স্পষ্ট বোঝা যায় তার গোলের ক্ষুধার তাড়না। শিকারি সিংহের ন্যায় ওত পেতে বসে থাকেন গোল করে প্রতিপক্ষকে শিকার করবার৷ ২০১৯/২০ মৌসুমে ৩১ ম্যাচে বুন্দেসলিগার ৩১ ম্যাচে করেছিলেন ৩৪ গোল। আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলেছিলেন ১০ ম্যাচ, গোল করেছেন ১৫ টি।

প্রতিটি মৌসুমে যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার এক অদম্য উদ্যম নিয়ে মাঠে নামেন পোল্যান্ড জাতীয় দলের আক্রমণ ভোমরা লেওয়ানডস্কি। গত মৌসুম অর্থাৎ ২০২০/২১ মৌসুমে ২৮ ম্যাচ খেলার সু্যোগ হয়েছিল দারুণ এই স্ট্রাইকারের। সেই ২৮ ম্যাচেই করেছেন ৪১ গোল। ৩২ বছর বয়সে ৪১ গোলের পাশাপাশি করেছিলেন ৭ অ্যাসিস্ট। ১১ ম্যাচে নিজেকে করেছেন ম্যাচ সেরা খেলোয়াড়। ইউরোপীয় লিগ ফুটবলে গোলদাতাদের তালিকার শীর্ষ স্থানে নিজেকে বসিয়েছিলেন লেওয়ানডস্কি।

এখনো পর্যন্ত খেলা ৪৭৭ ম্যাচে ৩৭১ গোল যেন তাঁর গোল করার প্রতিভাকে আরো স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলে। তার মধ্যে এই মৌসুমে জার্মান বুন্দেসলিগায় খেলা ৪ ম্যাচে করেছেন ছয় গোল। গেল ১৪ তারিখ রাতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বের প্রথম রাউন্ডে বার্সালোনার ঘরের মাঠে দুই গোল করে নিজের ক্লাব বায়ার্নকে এনে দিয়েছেন পূর্ণ তিন পয়েন্ট। এর পাশাপাশি রাবার্ট লেওয়ানডস্কি নিজের এই মৌসুমে সর্বমোট গোলের সংখ্যা বাড়িয়ে করেছেন আটটি।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রথম ম্যাচে তাঁর করা গোল দু’টি বিশ্লেষণ করলে তাঁর আক্রমণাত্মক মনোভাব ও জ্ঞানের পরিধি কিছুটা হলেও পরিমাপ করা সম্ভব।

আক্রমণ ভাগের খেলোয়াড় সংকট ও রক্ষণে দূর্বলতা নিয়ে খেলতে হবে বিধায় মধ্যমাঠকে আঁটসাট করে খেলতে নামান বার্সা কোচ রোনাল্ড কোমেন। গোলের আশায় বল নিয়ে বার্সালোনার ডি-বক্সের কাছাকাছি জেতেও যেন কষ্টের সীমা নেই টমাস মুলার, সানে, লেওয়ানডস্কিদের। ৩৪ মিনিটে মুলার বল জালে জড়ানোর পর কার্যকরী কোন আক্রমণ সাজাতে ব্যর্থ হয় জার্মান জায়ান্টরা।

কিন্তু একের পর এক আক্রমণ চালাতেই থাকেন মুলার, মুসিয়ালা ও লেওয়ানডস্কি। ম্যাচের ৫৬ মিনিটে মুসিয়ালার শট সাইড বারে লেগে ফেরত আসে। বল ফেরত আসে বায়ার্ন ফরোয়ার্ড লেওয়ানডস্কির পায়েই । এখানে ভাগ্যের যতটা না কৃতিত্ব তার সমপরিমাণ কিংবা একটু বেশি কৃতিত্ব পেতে পারেন লেওয়ানডস্কি। তিনি একজন জাত স্ট্রাইকার হিসেবে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় নিজেকে নিয়ে হাজির হতে পেরেছিলেন।

তার উপর সজোরে ছুটে আসা বলে আলতো পায়ের ছোয়ায় বল যে জালে জড়িয়েছেন তা অন্য কোন খেলোয়াড়ের মিস করার সম্ভাবনা শতকরা হিসেবে ৪০-৫০ ভাগ। এতেই প্রমাণ হয় তার গোল স্কোরিং ক্যালিবার ও সাথে বল কন্ট্রোলের মুন্সিয়ানা।

এরপর বার্সেলোনার রক্ষণ বায়ার্ন মিউনিখকে আটকে রাখে বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু খেই হারিয়ে ফেলে ম্যাচের ৭৬ মিনিটে। বার্সার ভাগ্য সহায় হতে চাইলেও তা হতে দেননি বায়ার্নের শিকারি সিংহ লেভানডস্কি। সার্জ গ্যানাব্রির শট আবার সাইড বারে লেগে রিবাউন্ড হয়ে ফিরে আসে লেওয়ানডস্কির পায়ে।

একজনকে কাটিয়ে সজোরে বাম পা চালিয়ে আদায় করে নেন নিজের দ্বিতীয় ও মৌসুমের অষ্টম গোল৷ এই গোলে দেখা মেলে সেই অ্যামাজনের সিংহের ন্যায় ঠাণ্ডা মাথায় শিকার করবার প্রবণতা। স্কোরিং দক্ষতার পাশাপাশি একজন স্ট্রাইকার হিসেবে ঠাণ্ডা মাথায় নিজের কাজটা সেরে ফেলার মতো দক্ষতা লেওয়ানডস্কির রয়েছে, তাও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।

গোলস্কোরার হিসেবে রবার্ট লেওয়ানডস্কির প্রশংসা করে শেষ করা দূরুহ এক কাজ। হয়ত এই মৌসুমেও তিনি গোলের ক্ষুধায় শিকার করে যাবেন একের পর এক প্রতিপক্ষকে। মৌসুমের শুরুতে প্রত্যাশার পারদ আকাশ ছুয়েছে, লেভানডস্কি সেই আকাশে উড়ে বেড়াবেন কি না তা দেখার অপেক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link