অটল এক প্রাচীর

আধুনিক ফুটবলে রক্ষণের সংজ্ঞা খানিক বদলে গিয়েছে। এখন একজন রক্ষণভাগের খেলোয়াড় যে শুধু রক্ষণেই মনোযোগ দেবে তা নয়। সে আক্রমণ সাজাতে সাহায্য করবে, সে হঠাৎ হঠাৎ রক্ষণ ছেড়ে বল নিয়ে দেবে ভোঁ-দৌড়। কর্ণার করবেন, কর্ণারের সময় প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে থাকবে। কত সব দায়িত্ব! এখন আর একজন রক্ষণভাগের খেলোয়াড় শুধুই রক্ষণের দেবে না মনোযোগ।

অথচ এইতো বছর কুড়ি আগেও রক্ষণ ছিল এক আলাদা শিল্প। সে শিল্পের বহু কারিগরও ছিল। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন আর্জেন্টিনার রবার্তো আয়ালা। নির্ভয়, বলিষ্ঠ, সংকল্পবদ্ধ এক ডিফেন্ডার আয়ালা। যেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করা কোন এক যাযাবর। প্রতিকূলতা নিয়ে যার নেই কোন ভয়। বীরদর্পে চষে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। তবে আয়ালা তাঁর লক্ষ্যে স্থির। রুখতেই হবে শত আঘাত।

তিনি ছিলেন রক্ষণের প্রহরী। প্রতিপক্ষকে তিনি রুখবেন না তো রুখবে কে?

১৪ এপ্রিল ১৯৭৩ সালে আর্জেন্টিনার পারানায় জন্ম তাঁর। শৈশবে তাঁর সঙ্গী হয়েছিল রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের ছোট্ট একটি ক্লাব ফেরো। সেখানে বছর তিনেক কাঁটিয়ে আর্জেন্টিনার অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব রিভার প্লেটে গিয়ে হাজির হন আয়ালা। সেখানেই নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন তিনি।

রক্ষণের ভয়ংকর মাধুর্য্যের দেখা মিলত তাঁর খেলায়। তিনি নিজেই যেন এভারেস্ট। তাঁকে টপকে যাওয়া প্রায় যেন অসম্ভব। তাঁর সে দৃঢ়তা লোকমুখে ছড়িয়ে ল্যাতিন আমেরিকা থেকে পৌঁছে যায় ইউরোপের দেশ ইতালিতে। সেখানে তিনি শুরু করেন নিজের ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় যাত্রা। ইতালিয়ান ক্লাব পার্মা তাঁকে আর্জেন্টিনা থেকে উড়িয়ে নিয়ে যায় ইতালিতে। পরিচয় করিয়ে দেয় ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের সাথে।

আয়ালা সবখানেই যেন মানিয়ের নেওয়ার অদম্য স্পৃহা নিয়ে খেলে গিয়েছেন। ইউরোপ হোক অথবা ল্যাতিন আমেরিকা আয়ালার কাছে ফুটবলটা স্রেফ ফুটবল আর তিনি একজন ডিফেন্ডার। তাঁর ভিশন একেবারে ছিল অনড়, রুখে দেও প্রতিপক্ষের সব আক্রমণ। বড় বড় ক্লাবের নজর ঠিক কি করে কাড়তে হয় তা তিনি একেবারে নিজের আয়ত্বে নিয়ে এসেছিলেন।

সময় খুব বেশি নেননি, ক্লাব ফুটবলের ‘হট কেক’ বনে যেতে। তবে পারমা তাঁকে লোনে পাঠিয়েছিল নাপোলিতে। সেখান থেকে ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে তাঁর ঠাঁই হয় ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবলের পরাশক্তি এসি মিলানে। সেখানে এসে তাঁকে একাদশে নিজের জায়গা করে নিতে রীতিমত লড়াই করতে হয়েছে সে সময়ে অন্যতম সেরা দুই রক্ষণ ভাগের খেলোয়াড় অ্যালেসান্দ্রো কস্তাকুর্তা ও পাওলো মালদিনির সাথে। তিনি বেশ একটু বিপাকেই পড়ে যান তিনি। যদিও কস্তাকুর্তা তাঁর ক্যারিয়ারের গোঁধুলি লগ্নের দিকে ধাঁবিত হচ্ছিলেন।

তবে মিলান কস্তাকুর্তার পরিবর্তে আলেসান্দ্রো নেস্তাকে বেছে নেন তাঁদের পরবর্তী পছন্দ হিসেবে। খেলার ধরণের তারতম্যের কারণে এমন সিদ্ধান্ত, আয়ালার জন্য নেতিবাচক বটে। তিনি আর ঠিক সেখানে থাকাটা নিজের ক্যারিয়ারের জন্য ফলপ্রসূ মনে করেননি। স্যান সিরোর সাথে দুই বছরের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তিনি চলে যান স্পেনে। সেখানে ভ্যালেন্সিয়া।

সেখানটায় নিজের প্রতিভার সম্পূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছিলেন রবার্তো আয়ালা। হয়ে যান ভ্যালেন্সিয়ার রক্ষণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেনানি। তাঁদের হয়ে পরপর দুইবার উয়েফা কাপের ফাইনাল খেলার গৌরব অর্জন করে একবার ইউরোপ সেরার শিরোপা ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল রবার্ত আয়ালার। তাছাড়া ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে লা লিগাও জিতেছিলেন। তবে তাঁর জীবনের আক্ষেপ হয়ত হয়ে রইবে ২০০৬ এর বিশ্বকাপ।

কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে ১-১ গোলে নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ করেছিল আর্জেন্টিনা। আলবি সেলেতেদের হয়ে গোলটি করেছিলেন আয়ালা। কিন্তু টাইব্রেকারে তাঁর করা গোল মিসের কারণেই হেরে বিদায় নিয়েছিল আর্জেন্টিনা। ঠিক তাঁর পরের বছরই আরেকদফা বিষাদের সম্মুখীন হন আয়ালা। ২০০৭ সালে হওয়া কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে অনায়াসে জয় পেয়ে যাবে ভেবেছিল আর্জেন্টিনা।

তবে আর্জেন্টিনার রক্ষণ দূর্গভেদ করে তিন দফা ব্রাজিলের পক্ষে বল আর্জেন্টিনার জালে জড়ায়। তাঁর মধ্যে একটি আশে আয়ালার পা থেকে। নিজের জালে নিজেই বল জড়িয়ে আক্ষেপের তীব্র তাপে পুড়ে ফুটবলকে বিদায় জানান রক্ষণের একসময়ের ত্রাস রবার্তো আয়ালা। এমনকি ২০০২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ভরাডুবিতেও অন্যতম কারণ মনে করা হয় তাঁকেই। ফলে, জাতীয় দলের ক্যারিয়ারটা যে তাঁর জন্য আক্ষেপের – সেটা বলাই বাহুল্য।

বলা হত আকাশে ভেসে আসা বল তাঁকে ডিঙিয়ে কেড়ে নেওয়াটা ছিল একপ্রকার অসম্ভব। পুরোদস্তুর একজন ‘স্টপার ব্যাক’ ছিলেন রবার্ত আয়ালা। তবে আক্ষেপ তাঁর হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে বারেবার। সে জায়গায় আর্জেন্টিনার হয়ে কোন শিরোপা জিততে না পারার একটা সাদা-কাল অধ্যায় লেখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link