সংশয়ে রোমান সানার অলিম্পিক স্বপ্ন!

বাংলাদেশের আর্চারি আর রোমান সানা যেন একসুতোয় গাঁথা।

তীর-ধনুকের খেলাকে দেশে ও বিদেশে পরিচিত করে তুলতে খেলোয়াড় হিসেবে রোমানের অবদান অনেক। বয়সভিত্তিক দল থেকে সাফল্যের সিড়ি বেয়ে খুলনার এই আর্চার এখন জাতীয় দলে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। সাফল্য পেয়েছেন ছোট-বড় অনেক টুর্নামেন্টেই।

বাংলাদেশের প্রথম আর্চার হিসেবে সরাসরি অলিম্পিক খেলার অসামান্য যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বৈশ্বিক এই টুর্নামেন্টের জন্য এখন নিজেকে তৈরিও করছেন।

এক বছর পিছিয়ে চলতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে টোকিও অলিম্পিক। কিন্তু দেশে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ দুটি টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হওয়ার পর ফেডারেশন বিকল্প ভাবনা ভাবছে। পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে অলিম্পিকে যে কেউ খেলতে পারে বলে ফেডারেশন সুত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি কয়েকটা ঘরোয়া আসরে রোমান সানার ব্যর্থতার কারণে তার বিকল্প ফেডারেশনর খুজছে বলে জানা গেলো!

অথচ দিনে দিনে পারফরম্যান্সের গ্রাফটাকে উন্নতি করে যাচ্ছিলেন রোমান। দেশে কিংবা বিদেশে সবখানেই লাল সবুজের পতাকাকে সমুজ্জল করেছেন। ইসলামী সলিডারিটি থেকে শুরু করে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ও সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে নিয়মিত সাফল্য পেয়েছেন।

নেপালে অনুষ্ঠিত ‘দক্ষিন এশিয়ার অলিম্পিক’ খ্যাত আসরে যে ১০টি স্বর্ন জিতেছিল আর্চারী; সেখানে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল রোমানের। আর বিশ্ব আর্চারী চ্যাম্পিয়নশীপের কথা তো সবারই জানা। প্রথমবারের মতো দেশের কোন আর্চার ব্রোঞ্চ পদক জেতে সেই আসরে। ফলস্বরুপ সরাসরি অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করার দুর্লভ কৃতিত্ব অর্জন করেন দেশসেরা এই আর্চার।

হিসাব করলে রোমানের বাজে সময়টা শুরু এসএ গেমসের পর থেকে। শুরুতে জাতীয় আসরে স্বর্ন জিততে পারেননি। আর এবার বিজয় দিবস আর্চারীতে কোন পদক জিততে পারেননি রোমান! যা তার নামের পাশে বড়ই বেমানান। কিন্তু একটা কিংবা দুইটা আসরে ব্যর্থতা দিয়ে কি রোমানের পুরো ক্যারিয়ারের মূল্যায়ন করা সম্ভব?

বিশ্ব আর্চারীতে পাওয়া পদকের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে অলিম্পিকে বাংলাদেশের পদক জয়ের জন্য তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখছে ক্রীড়াপ্রেমী মানুষরা। এখন রোমান অলিম্পিকে খেলতে পারবেন কিনা তা সেটি নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। নিশানা ভেদ করার লড়াইয়ে কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

সর্বশেষ বিজয় দিবসের আসরে একক কিংবা দ্বৈত বিভাগে জিততে পারেননি স্বর্ন। এরপরই অনেকটা হঠাৎ করেই ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজিব উদ্দিন আহমেদ চপল বলেন, ‘বেশ কিছুটা সময় ধরে রোমান সানা ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছেনা। এমনটি চলতে থাকলে টোকিও অলিম্পিকে আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে। মনে রাখতে হবে রোমান নয়, অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করবে বাংলাদেশ। পরিবর্তন হলে এখন যারা ভাল পারফরম্যান্স করছে সেখান থেকে কাউকে পাঠানো হবে।’

এই কথা শোনার পর নিশ্চয়ই ভাল লাগার কথা নয় রোমানের। অনেকে আবার তাকে চাপে ফেলার জন্য এমনটি করা হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন। কিছুটা বিরক্ত হয়ে কেউ কেউ তো বলেই ফেলেছেন, রোমানকে একপ্রকার হুমকি দেওয়া হচ্ছে!

ফেডারেশন চাইলে যে কাউকে টোকিও অলিম্পিকে খেলার জন্য পাঠাতে পারে। সেই নিয়মের দোহাই দিয়ে তারা হয়তো রোমানকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিতে পারে। কিস্তু সেটা কি তার সাথে অন্যায় করা হবেনা?

করোনার এই সময়ে নয় মাস পর খেলতে নামেন আর্চাররা। সেখানে সাফল্য না পাওয়ায় রোমানকে নিয়ে নতুন ভাবনা ফেডারেশনের। বিজয় দিবসের আগে জাতীয় আসরেও স্বর্ন জেতা হয়নি রোমানের। অনেকটা অদ্ভুতুরে হওয়া সেই আসর নিয়ে সমালোচনা আছে। অথচ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রেকর্ড স্কোর গড়ে তিন স্বর্ন জিতেছিলেন রোমান। দেশের হয়ে ১০টি স্বর্নজয় তো তার নেতৃত্বেই হয়েছে। নেপালে সেই আসরের পর কোন ছুটি না দিয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপের আয়োজন করা হয়। সেখানে এসএ গেমসের পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি রোমান।

এরপর তো করোনা ভাইরাস সবকিছু কেড়েও নিয়েছে। বিজয় দিবস টুর্নামেন্টে কোয়ালিফাইয়ে কিন্তু রেকর্ড স্কোর গড়েছিলেন রোমান। কিন্তু চুড়ান্তপর্বে এসে মনসংযোগটা ধরে রাখতে পারেননি।

সে কারণে নিজেই নিজের উপর বিরক্ত ছিলেন রোমান, ‘একটা টুর্নামেন্টে খারাপ ফল হতেই পারে। এটা ঠিক হয়ে যাবে। এর আগে তো ক্যাম্পে একটি কোয়ালিফিকেশন রাউন্ডে ভাল করতে পারিনি। নিয়মিত টুর্নামেন্টে আবারো সাফল্য পাবো বলে আশা করছি।’

ছয় মাসেরও বেশি সময় বাকি রয়েছে অলিম্পিকের। এর আগে এশিয়া কাপ ছাড়াও বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবেন রোমান। এখন ফেডারেশনের কথায় যদি চাপে পড়ে যান তিনি তাহলে আখেরে ক্ষতিটা হবে বাংলাদেশের আর্চারির। তবে কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ চাপ না নিতে রোমানের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, ‘খারাপ সময় যে কোন খেলোয়াড়েরই আসতে পারে। সেটিকে পেছনে ফেলে কঠোর অনুশীলনের কোন বিকল্প নেই তার। আশা করি রোমান তার পুরনো পারফরম্যান্স ফিরে পাবে।’

বিজয় দিবসের আসর দিয়ে একবছর পর আর্চারীর আসর মাঠে ফেরে। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারীতে একটা ট্রায়াল টুর্নামেন্টে খেলেছিল। কোয়ালিফিকেশন রাউন্ডে রিকার্ভ পুরুষ এককে রোমান সানা ৭২০-এর মধ্যে ৬৫৪ স্কোর করে প্রথম হয়েছিলেন। কিন্তু চুড়ান্ত পর্বে এসে যেন আর সেই ধারা ধরে রাখতে পারেননি। টোকিও অলিম্পিক আর্চারীতে ৩৮ টি দেশ কোয়ালিফাই করেছে। এর মধ্যে এশিয়ার দেশ ১৪টি। সুযোগ আছে আরো। বাংলাদেশও মেয়েদের এককে কোয়ালিফাই করার চেষ্টা করবে। আগামী ১৮ থেকে ২১ জুন ফ্রান্সের প্যারিসে হবে কোয়ালিফাই রাউন্ড।

টোকিও অলিম্পিকে মূল স্বপ্নটা কিন্তু রোমান সানাকে নিয়েই আবর্তিত হচ্ছে। ক্যারিয়ারে সবমিলিয়ে পাওয়া সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ওয়ার্ল্ড আর্চারীতে ব্রোঞ্চ জিতেছিলেন ব্যক্তিগত নৈপুন্যে। বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ‘গো ফর গোল্ড’ আবর্তিত যে সকল আর্চারদের নিয়ে তার মধ্যে অগ্রগন্য এই রোমান।

এর আগে ২০১৯ সালটি দুর্দান্ত কাটানোর স্বীকৃতি আরো একবার পেয়েছিলেন রোমান সানা। বিশ্ব আর্চারির সমীক্ষায় সেরা চমকের পুরস্কার জিতেছেন। এবার কোন পদক না জিতেই সেরাদের মধ্যে নিজের নামটি দেখে দারুণ উচ্ছসিত হয়েছিলেন রোমান। সাথে কোচ হিসেবে সেরার স্বীকৃতি মিলেছে মার্টি ফ্রেডরিখের। কোচ ফ্রেডরিখ রোমানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেই ফেলেন, ‘তোমার জন্য আমি গর্বিত।’

বাংলাদেশে মার্টিন ফ্রেডরিখ আসার পরই মূলত আর্চারী এই অভাবনীয় বদলে যাওয়া। আগে যা হয়নি সেটাই এখন প্রতিনিয়তই হচ্ছে। ২০১৭ সালে যেখানে অতি সাদামাটা খেলা ছিল আর্চারী সেখানে ২০১৮ সাল থেকেই সবকিছু বদলে যেতে থাকে। এমনভাবেই এই পরিবর্তনটা আসে যেখানে অনেক খেলাই এখন পেছনে পড়ে গেছে। ২০১৯ সালটি দারুণ কাটানোর পর ২০২০ সালের পয়লা দিনই রোমান পেয়েছেন আরো বড় সুখবর। পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতায় এবার বিশ্ব আর্চারি বর্ষসেরা আর্চারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠেন তিনি।

ওই সময় প্রকাশিত তালিকায় রিকার্ভ পুরুষ এককে ২০১৯ সালে সেরা পাঁচে ছিল রোমানের নাম। সবমিলিয়ে দারুণ সময় কাটানোর পর এখন নতুন লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে তাকে। সেটি পদক জিতে নিজেকে প্রমানের।

একজন খেলোয়াড়ের জীবনে খারাপ সময় আসতেই পারে। সেটিকে স্বাভাবিক হিসেবে নেবার মতো মানসিকতা থাকতে হবে কর্মকর্তাদের। দুঃসময়ে খেলায়াড়দের পাশে দাড়ানোর মতো মহানুভবতা দেখাতে হবে। শুধু সুসময়কে মূল্যায়ন করার মাধ্যমে একজন রোমান সানাকে ওজন করা ঠিক হবেনা। বাংলাদেশের আর্চারদের যে অধরা অলিম্পিক স্বপ্ন, সেটি তার মাধ্যমে পূরণ হয়েছে, সেই রোমান সানাকে ছুড়ে ফেলার আগে অন্তত তার নিটক অতীতকে মনে করা উচিত। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আসরে এখন পর্যন্ত ৩৭টি স্বর্নপদক জিতেছে বাংলাদেশ। সেখানে জ্বলজ্বল করা নাম রোমানের। ভবিষ্যতের জন্য এই নামটিকে রাখতে হবে সযতনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link