‘রস’-এর হাড়ি ফুরলো

আর বাড়বে না রানসংখ্যা, বর্নাঢ্য এক ক্যারিয়ারে ফুল স্টপ বসিয়ে দিয়েছেন রস টেলর। আর কখনো ব্ল্যাক ক্যাপদের হয়ে হাল ধরতে আসবেন না। আর কখনো নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপে সাঁকো হয়ে দাঁড়াবেন না; সমৃদ্ধ করবেন না দলের ব্যাটিং শক্তিকে। ২০০৬ সালে এসেছিলেন এক টুকরো সম্ভাবনা নিয়ে, সে সম্ভাবনা'র কলি থেকে ফুল হয়ে ফুটেছেন; এখন ২০২২ সালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে ফিরে যাচ্ছেন 'লুটেরু রস পৌতোয়া লোট টেলর’।

টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ১০০ টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের কলিন কাউড্রে। ওয়ানডেতে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে রিচার্ড হ্যাডলি খেলেছিলেন ১০০ ম্যাচ এবং টি-টোয়েন্টিতে শোয়েব মালিক প্রথম ক্রিকেটার গড়েছিলেন এমন কীর্তি। এরপরে আরও অনেক ক্রিকেটার এই মাইলফলক অতিক্রম করলেও ইতিহাস বিশেষ ভাবে মনে রাখবে এদেরকেই।

ইতিহাস আরেকজনকেও মনে রাখবে, মনে রাখতে হবে কারণ ক্রিকেট ইতিহাসের ‘প্রথম’ হিসেবে তিন ফরম্যাটে আলাদাভাবে শততম ম্যাচ খেলার গৌরব অর্জন করেছেন একজন ক্রিকেটার। তার নাম ‘লুটেরু রস পৌতোয়া লোট টেলর’।

নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটার ‘রস টেলর’ নামেই বৈশ্বিক ভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। রস টেলর নামটি শুনলেই ক্রিকেটের টুকটাক খবর রাখা ভক্তের চোখেও হাস্যজ্জ্বল এক কিউই ব্যাটসম্যানের ছবি ভেসে উঠে যার ব্যাটে ফোয়ারা’র জলের মত রানবন্যা নামতো।

‘নাম’তো বলেছি। কারণ ব্যাট-প্যাড নিয়ে আর কখনো বাইশ গজে বোলারদের শাসন করতে আসবেন না তিনি; আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিয়েছেন যে। ২০২২ সালের শুরুতে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলেছিলেন বিদায়ী টেস্ট; আর এপ্রিলে এসে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে বিদায় নিলেন জাতীয় দল থেকে।

২০০৬ সালে ওয়ানডে ফরম্যাটে অভিষেক, এরপর টি-টোয়েন্টি ক্যাপও মাথায় পরিয়ে দেয়া হয়েছিল। এক বছর পরেই আভিজাত্যের টেস্ট ফরম্যাটে পা রেখেছিলেন রস টেলর। এরপর থেকে কেটেছে একযুগেরও বেশি। কত কিছু ঘটে গিয়েছে পৃথিবীতে, ঘটেছে টেলরের ক্যারিয়ারেও।

যে ওয়ানডে ক্রিকেট দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ করেছিলেন সেখানেই নিউজিল্যান্ডের হয়ে তিনি এখন সর্ব্বোচ রান সংগ্রাহক। এখন পর্যন্ত ২৩৬টি ওয়ানডে খেলে ৪৭.৫২ ব্যাটিং গড়ে ৮,৬০২রান করেছেন। পঞ্চাশ ওভারের এই ফরম্যাটে ২১টি শতক এবং ৫১টি অর্ধশতকের মালিক রস টেলর।

৫০ ওভারের ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮,০০৭ রান করেছেন স্টিফেন ফ্লেমিং। বিদায় লগ্নেও আইসিসির ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ে তিন নম্বরে রয়েছেন রস। মানে, স্বর্ণালী সময়েই তিনি ব্যাটটা তুলে রাখছেন।

লাল বলের টেস্ট ক্রিকেটেও কিউই ক্রিকেট সাম্রাজ্যের অধিপতি’র আসনে আসীন হয়েছেন রস টেলর। ১১২ টেস্টে ৪৪ এর বেশি গড়ে করেছেন ৭৬৮৪ রান। ৩৫টি অর্ধশতক আর ১৯ টি শতক তুলে নিয়েছিলেন রস। টেস্ট ক্রিকেটেও ব্ল্যাক ক্যাপসদের হয়ে তার চেয়ে বেশি রান করেনি আর কেউই।

১২২.৩৭ স্ট্রাইক রেটে টি-টোয়েন্টিতে টেলর করেছেন ১৯০৯ রান; গড়টা ২৫ এর বেশি। কোন শতক না থাকলেও রয়েছে সাতটি অর্ধশতক। কিউই ইতিহাসে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তৃতীয় সর্ব্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি।

ক্যারিয়ারের শুরু পর্দার আড়ালে থাকাই পছন্দ ছিল টেলরের, আড়াল থেকেই নিজের দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। মিডল-অর্ডারে যেকোনো দলের জন্য তার মতো ব্যাটসম্যান আশীর্বাদ স্বরূপ। নিজের তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেদিন ১৩৩ বলে অপরাজিত ১২৮ রানের ইনিংস খেলে তিনি ঘোষনা দিয়েছিলেন নিজের আগমনবার্তা। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে রান করে যাচ্ছেন।

বর্তমান ক্রিকেটে সেরা ব্যাটসম্যানদের কথা ভাবলে সবার আগে মনে পড়বে বিরাট কোহলি, বাবর আজম, কেন উইলিয়ামসন কিংবা স্টিভ স্মিথ,ওয়ার্নারদের নাম। কোনো এক অজানা কারণে লাইমলাইটের একটু দূরেই অবস্থান করেন রস টেইলর, যার কারণে ধারাবাহিকভাবে রান করা সত্ত্বেও সেরাদের কাতারে তার নাম উচ্চারিত হয় না।

২০১৪ সালের পর থেকে কমপক্ষে চার হাজার রান করেছে এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তার ব্যাটিং গড় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এসময় সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন বিরাট কোহলি।

রান তাড়ায় অবিশ্বাস্য পটু এই ব্ল্যাক ক্যাপস তারকা। নিউ জিল্যান্ডের বড় লক্ষ্য তাড়া করে জয় পাওয়া ম্যাচগুলোতেও রস টেইলরের অবদান সবচেয়ে বেশি। এখন পর্যন্ত নিউ জিল্যান্ড ওডিআইতে ছয়বার তিন শতাধিক রান তাড়া করে ম্যাচ জিতেছে।

যার মধ্যে টেইলর পাঁচ ম্যাচে একাদশে ছিলেন এবং চার ম্যাচেই তিনি শতক হাঁকিয়েছেন। এমনকি নিজের ওয়ানডেতে ক্যারিয়ারসেরা ১৮১ রানের ইনিংসটিও খেলেছিলেন ইংল্যান্ডদের বিপক্ষে ৩০০ এর বেশি রান তাড়া করতে নেমে।

নিজের স্বভাবসুলভ ব্যাটিং পজিশনে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান রস টেলর। চার নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে তার চেয়ে বেশি রান করতে পারেনি সমসাময়িক কোন ব্যাটসম্যান। শতক হাঁকানোর দিকেও তিনি সেরা। এই ব্যাটিং পজিশনে সর্বাধিক সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন রস টেলর। এই পজিশনে ওয়ানডেতে ৫১.৫২ এভারেজে ৭৬৭৬ রান করেছেন তিনি। শতক হাঁকিয়েছেন ১৯টি।

ভারতের হয়ে শচীন টেন্ডুলকার, শ্রীলঙ্কার মাহেলা জয়াবর্ধনে, দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস, ওয়েস ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা এবং পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদ যে দায়িত্ব পালন করেছেন, নিউ জিল্যান্ডের হয়ে তিনি সেই দায়িত্ব পালন করছেন।

টেস্ট ক্রিকেটে চার নম্বর ব্যাটিং পজিশনে সবচেয়ে বেশি রান তোলা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় এই পাঁচজনের পরের অবস্থানটা তাই রস টেলরেরই। লঙ্গার ভার্সনের ক্রিকেটে চার নম্বরে রস টেলর ৪৭.২৫ গড়ে সাত হাজারের বেশি রান করেছেন। অর্জনের খাতাটা কানায় কানায় পূর্ণ তাঁর।

তবে আর বাড়বে না রানসংখ্যা, বর্নাঢ্য এক ক্যারিয়ারে ফুল স্টপ বসিয়ে দিয়েছেন রস টেলর। আর কখনো ব্ল্যাক ক্যাপদের হয়ে হাল ধরতে আসবেন না। আর কখনো নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপে সাঁকো হয়ে দাঁড়াবেন না; সমৃদ্ধ করবেন না দলের ব্যাটিং শক্তিকে। ২০০৬ সালে এসেছিলেন এক টুকরো সম্ভাবনা নিয়ে, সে সম্ভাবনা’র কলি থেকে ফুল হয়ে ফুটেছেন; এখন ২০২২ সালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে ফিরে যাচ্ছেন ‘লুটেরু রস পৌতোয়া লোট টেলর’।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...