শচীন টেন্ডুলকারের এই ইনিংসটা অনেক কারণেই স্পেশাল। বিশ্বকাপে শচীনের মোট ছয়টা সেঞ্চুরি, অথচ ‘বিশ্বকাপের শচীন’ প্রসঙ্গ এলেই সবার প্রথমে মাথায় আসে এই ৯৮ রানের ইনিংসটার কথা। পাকিস্তানি বোলিং আক্রমণকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া শচীন সেদিন এতটাই বিধ্বংসী মুডে ছিলেন, যা খেলা শুরুর আগে কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারে নি।
কপিলের ১৭৫ কিংবা সৌরভের ১৮৩ মাথায় রেখেই বলছি, বিশ্বকাপে কোন ভারতীয় ব্যাটসম্যানের খেলা সেরা ইনিংস সম্ভবত এটাই। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে হাই ভোল্টেজ ম্যাচের প্রেশার সামলে শচীন যে মাস্টারক্লাস নকটি উপহার দিয়েছিলেন, তার সাথে অন্য কোন কিছুর তুলনা চলে না। যাকে বলে ‘ওয়ান্স ইন আ জেনারেশন’ টাইপ ইনিংস।
স্টাইলিশ বাঁ-হাতি ওপেনার সাঈদ আনোয়ারের কুড়িতম ওয়ানডে সেঞ্চুরির সুবাদে পাকিস্তানের ২৭৩ রানের দলীয় সংগ্রহটা মন্দ ছিল না। সুপার স্পোর্ট পার্কের বাউন্সি উইকেটে ২৭৪ রানের লক্ষ্য অনতিক্রম্য না হলেও ছিল দুরতিক্রম্য। যেখানে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আখতার, আব্দুল রাজ্জাকদের নিয়ে গড়া টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা পেস আক্রমণ ছিল পাকিস্তানের।
পাকিস্তানের দেয়া ২৭৪ রানের চ্যালেঞ্জের জবাবে শুরুতেই দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেয় শচীন-শেবাগের উদ্বোধনী জুটি। ৫.৩ ওভারেই আসে ৫৩ রান! ওভারপ্রতি ১০ করে! ভারতের ইনিংসের দ্বিতীয় আর শোয়েব আখতারের প্রথম ওভার থেকে দুজনে মিলে নিয়েছিলেন ১৮ রান!
টেন্ডুলকার রানের খাতা খুলেছিলেন ইনিংসের তৃতীয় বলে, ওয়াসিম আকরামকে স্বভাবসুলভ ব্যাকফুট পাঞ্চে চার মেরে। তারপর শোয়েবের ওই ওভারে পরপর তিন বলে খেলেন তিনটি নয়নাভিরাম শট, যা আজও সবার চোখে লেগে আছে।
তিনটি বলের গতি ছিল যথাক্রমে ১৫১, ১৫২ এবং ১৫৪.১ কিলোমিটার!
তিন শটের প্রথমটি ছিল ওভারের চতুর্থ বলে। অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরে কিছুটা শর্ট পিচড ধরনের বলটিতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি হলে হয়তো খেলারই চেষ্টা করতেন না শচীন। ব্যাটে না লাগালে নির্ঘাত ওয়াইড হত। অথচ সেদিন কী অবলীলায় ব্যাটটা বাড়িয়ে আগ্রাসী অথচ শৈল্পিক ভঙ্গিমায় স্ল্যাশ করলেন তিনি! ফলাফল? চোখের পলকে ডিপ থার্ড ম্যান অঞ্চলের মাথার ওপর দিয়ে বিশাল ছক্কা!
দ্বিতীয় শটটি ছিল শচীনের ‘ট্রেডমার্ক’ রিস্টি ফ্লিক। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে মিডল স্টাম্প বরাবর গুড লেংথে পড়া বলটিকে কব্জির মোচড়ে অনায়াসে পাঠিয়ে দিলেন ডিপ স্কয়ার লেগ অঞ্চল দিয়ে সীমানার বাইরে!
তবে সবচেয়ে ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ ছিল বোধ হয় তৃতীয় শটটি। আয়েশি ভঙ্গিতে অফস্টাম্পের দিকে খানিকটা সরে এসে ফুল ফেস অব দ্য ব্যাটে ‘অন ড্রাইভ’ কিংবা ‘পাঞ্চ’ বললে ভুল হবে; জেন্টল ‘পুশ’ করলেন বলটিকে! শটটিতে ছিল না কোন আহামরি ব্যাকলিফট কিংবা ফলোথ্রু! তবে যা ছিল তা হল নিখুঁত টাইমিং! চোখের পলকে লং অন অঞ্চল দিয়ে বল চলে গেল বাউন্ডারি পেরিয়ে!
দলীয় ৬৭ রানের মাথায় ওয়াসিম আকরামকে সোজা ব্যাটে মারা সেই দর্শনীয় ব্যাকফুট ড্রাইভের কথা মনে আছে আপনাদের? ফটোগ্রাফারের জন্য পোজ দেয়া সেই মোহনীয়, আইকনিক ফলোথ্রু! সম্ভবত আগের শটগুলোর চেয়েও এইটা বেশি সুন্দর, মনোমুগ্ধকর। কোনটা ছেড়ে কোনটাকে সেরা বলবেন আপনি?
সেঞ্চুরিয়নের সুপারস্পোর্টস পার্কে সেদিন কে মার খান নি? ওয়াসিম, ওয়াকার, শোয়েব, রাজ্জাক, আফ্রিদি — কেউই বাদ যান নি শচীনের নির্দয় ব্যাটের বেধড়ক পিটুনির হাত থেকে। তবে সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছিলেন ওয়াকার আর শোয়েব! ১০ ওভারের স্পেলে শোয়েব দিয়েছিলেন ৭২ রান! ওয়াকারের বোলিং ফিগারটা দেখাচ্ছিল আরো হতশ্রী, ৮.৪-০-৭১-২
শচীনের ব্যাটিংয়ে সেদিন প্রেশার কিংবা নার্ভাসনেসের লেশমাত্র ছিল না। দলীয় ৫৩ রানের মাথায় ওয়াকারের জোড়া আঘাতের ধাক্কাটা বুঝতেই দেন নি দলকে। পাওয়ারপ্লের ১০ ওভার শেষে স্কোর নিয়ে যান ৮৮-তে। ফিফটি পেরিয়েছেন ৩৭ বলে, ১৬তম ওভারে মাংসপেশিতে ক্র্যাম্পের কারণে একবার সেবা-শুশ্রূষাও নিতে হয়েছে।
দৌড়ে রান নিতে কষ্ট হচ্ছিল, সিঙ্গেল-ডাবলসের চাইতে তাই বাউন্ডারি মারার দিকেই মনোযোগী ছিলেন বেশি। নিঃসন্দেহে কালজয়ী ইনিংস; তবে একদম ফ্ললেস ইনিংস বললেও ভুল হবে। ব্যক্তিগত ৩২ রানের মাথায় ওয়াসিমের বলে একবার সুযোগ দিয়েছিলেন বটে, মিড অফে ক্যাচটা রাখতে পারেন নি আব্দুল রাজ্জাক, অল্পের জন্য ফঁসকে গিয়েছিল।
অবশেষে ইনিংসের ২৮তম ওভারে দলীয় ১৭৭ রানের মাথায় শোয়েবের হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে যখন ইউনুস খানের তালুবন্দী হলেন শচীন; নামের পাশে লেখা ৭৫ বলে ৯৮! ১২টি চার ও একটি ছক্কায় সাজানো ‘শচীন মাস্টারক্লাস’-এ ভর করেই ছয় উইকেট হাতে রেখে বিশ্বকাপে টানা চতুর্থবারের মত পাকিস্তানকে হারিয়েছিল ভারত।