রানের ফোয়ারা, অংকের পোকা আর স্পিনের বিষ

ক্রিকেট পাড়ায় সৌরাশিস লাহিড়ীর ডাক নাম প্যাটসি। সৌরভ গাঙ্গুলি তাঁর ডাকনাম ধরে ডেকেই বললেন, ‘প্যাটসি। হরিয়ানার তপন মেমোরিয়াল ক্লাবের একটা ছেলের নাম বলেছিলে না?’ জিজ্ঞাসু প্যাটসি বলে উঠল, ‘কে? শাহবাজ আহমেদ?’

সাল ২০১৬। সি কে নাইডু ট্রফিতে বেঙ্গল অনূর্ধ্ব ২৩ দল রেলওয়ের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে লিড নিয়েও নিজেদের প্রথম ম্যাচটি হেরে যায়। পরের ম্যাচেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বারোদার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে লিড নিয়ে তীরে এসে তরী ডুবে যায় বেঙ্গলের। টানা দুই ম্যাচ হেরে দলের কোচ সৌরাশিস লাহিড়ী জরুরী তলবে তখনকার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলার (সিএবি) সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলির সাথে দেখা করতে গেলেন।

ক্রিকেট পাড়ায় সৌরাশিস লাহিড়ীর ডাক নাম প্যাটসি। সৌরভ গাঙ্গুলি তাঁর ডাকনাম ধরে ডেকেই বললেন, ‘প্যাটসি। হরিয়ানার তপন মেমোরিয়াল ক্লাবের একটা ছেলের নাম বলেছিলে না?’ জিজ্ঞাসু প্যাটসি বলে উঠল, ‘কে? শাহবাজ আহমেদ?’

– হ্যাঁ। আমি ওর পরিসংখ্যান দেখলাম। ও আমাদের দলের জন্য স্পেশাল কিছু হতে পারে। ভাল ব্যাট করার পাশাপাশি ও তো দেখছি দারুণ বলও করতে পারে। বাংলায় এমন ক্রিকেটারের দেখা সহজে মিলে না। তুমি এখনো ওকে দলে নিচ্ছ না কেন?’

দাদার সাথে পুরনো কথা ভেবে হয়তো নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন কোচ লাহিড়ী। যে ছেলেটিকে নিয়ে তারা আজ থেকে অর্ধযুগ আগে একটি সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেছিল আজ সেই ছেলেটিই সম্ভাবনার বীজ বুনতে যাচ্ছে। ওয়াশিংটন সুন্দরের জায়গায় ভারতের ওয়ানডে দলে জায়গা পেয়েছে হরিয়ানার তপন মেমোরিয়াল ক্লাবের সেই ছেলেটি, শাহবাজ আহমেদ।

এক মৌসুমে ১০০০ রান আর ৫০ উইকেট! চাট্টিখানি কথা নয়। উপমহাদেশে অলরাউন্ডারের সংখ্যা কম না। কিন্তু সমান তালে ব্যাটিং, বোলিং- দুই ইউনিটেই পারফর্ম করা ক্রিকেটারের সংখ্যা কিন্তু বেশ কম। শাহবাজ আহমেদ সেটিই করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর।

ক্যারিয়ারের একদম শুরুর দিকে ছিলেন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান। পাশাপাশি পার্ট টাইম বোলিং করতেন। কিন্তু কিছু বছরের মধ্যেই স্লো লেফট আর্ম অর্থোডক্সে মুন্সিয়ানা দেখাতে শুরু করেন তিনি। আর ব্যাটিংয়ে তিনি কতটা পারদর্শী তা তার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪১ আর লিস্ট এ ক্রিকেটে ৪৭ গড় দেখলেই বোঝা যায়।

ক্লাব ক্রিকেটে বরাবরই সফল ছিলেন শাহবাজ। তপন মেমোরিয়াল ক্লাবে তিনি ছিলেন ছোট দলের বড় তারকা হয়ে। হরিয়ানার এ ক্লাবটি তখন মোহন বাগান, ইস্ট বেঙ্গল, কালিঘাটের মতো দলগুলোর সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারতো খুবই কম। তারপরও নিজের পারফরমেন্সে সমুজ্জ্বল শাহবাজ পরবর্তীতে সুযোগ পান বেঙ্গল দলে। রঞ্জি ট্রফি খেলেন এই দলের হয়েই।

ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করায় সুযোগ পান আইপিএলেও। রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে খেলছেন টানা ২ আসর। তবে আলাদা করে ২০২২ আইপিএলে ছিলেন দুর্দান্ত। ২২৭ রানের পাশাপাশি নিয়েছিলেন ৪ টি উইকেট। মূলত দলের বিপদে নিজের আক্রমণাত্বক ব্যাটিং টেম্পারমেন্টের কারণে নির্বাচকদের নজরে আসেন শাহবাজ আহমেদ।

ভারতের ওয়ানডে দলে সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন নিজেও। নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘ভারতে খেলা প্রত্যেকে ক্রিকেটারেরই ভারতের জার্সি গায়ে চাপানোর স্বপ্ন থাকে। অবশেষে আমারও সেই স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে। আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই বেঙ্গল ক্রিকেট দলকে যেখানে আমি খেলেছি এবং যারা আমার উপর আস্থা রেখেছিল। আশা করছি, সুযোগ পেলে আমার ব্যাটিং এবং বোলিং দিয়ে ভারতকে ম্যাচ জেতাতে পারব।’

  • প্রকৌশলী শাহবাজ আহমেদ

গত দেড় দশকে স্নাতক ক্রিকেটারের সংখ্যা যেখানে কমেছে সেখানে শাহবাজ আহমেদ স্নাতক করেছেন পুর প্রকৌশলের মতো কাঠখোট্টা এক বিষয় নিয়ে। তাহলে ক্রিকেট আর ইঞ্জিনিয়ারিং কিভাবে একসূত্রে গেঁথে গেল?

শাহবাজ আহমেদের কোচ পার্থ প্রতীম চৌধুরীর মতে, যখন ক্লাব ক্রিকেট সূচিতে কোনো ম্যাচ থাকতো না তখন শাহবাজ সেমিস্টারের জন্য পড়াশোনা করতো। এমনকি তার ত্রিকোণমিতি আর জ্যামিতির প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল।

তার আরেক কোচ লাহিড়ীর ভাষ্যমতে, ‘এই পড়াশোনাটা শাহবাজ আহমেদের ক্রিকেট ক্যারিয়ারেও বেশ সাহায্য করেছে। বর্তমান মডার্ণ ক্রিকেটে ক্রিকেট সেন্স ভাল হওয়াটাও জরুরি। আর তার জন্য পড়াশোনা বেশ জরুরি।’

  • পার্থ দা, ইউ শ্যুড ড্রাইভ টু দ্য অফিস

শাহবাজ আহমেদকে একদম ছোটবেলা থেকে দেখেছেন পার্থ চৌধুরি। একবার তার বাসার সামনে শাহবাজ একদম ব্র্যান্ড নিউ একটা গাড়ি রেখে দিলেন। চোখে বিস্ময় নিয়ে চৌধুরি বললেন, এটা তুমি তোমার বাবা-মায়ের জন্য হরিয়ানায় নিয়ে যাও। শাহবাজ আহমেদ কথা তার কেড়ে নিয়ে বলল, ‘পার্থ দা, ইউ শ্যুড ড্রাইভ টু দ্যা অফিস।’

এমন ভক্তি আর শ্রদ্ধায় সেদিন বেশ আবগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন কোচ পার্থ প্রতীম চৌধুরী। আইপিএলের কাড়ি কাড়ি অর্থের ঝনঝনাতিতে নিজের প্রিয় শিষ্য যে বখে যায়নি এ তো এক অদ্ভুত আনন্দের ব্যাপার। অবশ্য পার্থ চৌধুরি এর সব কৃতিত্বই শাহবাজের বাবা, মা আর তাদের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডকে দেন। শাহবাজের বোন পড়েন মেডিকেলে আর দাদা ছিলেন একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এমন পরিবারের ছেলের দীক্ষা তো আকাশ ছোঁয়াবেই।

অক্ষর প্যাটেলকে ছাঁপিয়ে ভারতের একাদশে এই মুহূর্তে নিজের জায়গাটা পাকা করা একটু কঠিনই শাহবাজ আহমেদের জন্য। তবে এসব চ্যালেঞ্জ আর ভারতে নীল জার্সি গায়ে চাপানো স্বপ্নই তো তাকে এগিয়ে দেবে তার পথে।

– টাইমস অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...