কখনোই বদলাননি তিনি – না শিল্পে, না চরিত্রে!

মাঠে অবিস্মরণীয় সব কীর্তি গড়লেও বিতর্ক কখনোই তাঁকে পেছনে ছাড়েনি। কখনো বান্ধবী, কখনো নেশা, ক্যাসিনো এসবে তিনি ডুবে থাকতেন। সেটা খেলোয়াড়ী জীবনেও যেমন ছিল, তেমনি মাঠ ছাড়ার পরও ছিল – আজো আছে। শেন ওয়ার্ন কখনোই বদলাননি – না শিল্পে, না চরিত্রে!

তখন ১৯৯৪ সাল। শেন ওয়ার্ন সেবারই প্রথম পাকিস্তান সফরে গেলেন। লেগ স্পিনের কিংবদন্তি আব্দুল কাদির ততোদিনে অবসর নিয়ে ফেলেছেন।

নিজের ‍উত্তরসূরিকে দেখতে ব্যাকুল কাদির। কারণ, ততোদিনে মাইক গ্যাটিংয়ের বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’ করে ফেলেছেন ওয়ার্ন। কাদিরের বাসায় নিমন্ত্রন পেলেন ওয়ার্ন। চললো দীর্ঘ সময়ের আড্ডা। একটা সময় কথা ফুরালো।

পার্সিয়ান একটা কার্পেটের দু’পাশে দু’জন পদ্মাসনে বসলেন। পিনপতন নীরবতা। কাদির বারবার বলটা ছুঁড়ছেন, ধরে ফেলছেন ওয়ার্ন। ক্রিকেট রোমান্টিকদের জন্য ভুবন কাঁপানো এক দৃশ্য।

খ্যাতনামা ক্রিকেট লিখিয়ে মাইক সেলভি লিখেছিলেন, ‘বল নয়, হঠাৎ করেই যেন মনে হচ্ছিল; ওয়ার্নের হাতে ক্রিকেটের সবচেয়ে সুন্দর শিল্পটি তুলে দিচ্ছিলেন সেদিন কাদির। আফসোস; কাদির চলে গেছেন, ওয়ার্নও নেই। ওয়ার্ন আর কারো হাতে তুলেও দিলেন না শিল্পটা — লেগ স্পিনের শিল্প!’

সেলভি ভুল বলেননি, আক্ষরিক অর্থেই ক্রিকেট মাঠের চেয়ে লেগ স্পিনের চেয়ে বড় কোনো শিল্প নেই। আর এই শিল্প গড়া কারিগরদের এই ভিড়ের অবিসংবাদিত নেতা আব্দুল কাদির। আর নব্বইয়ের দশকে থেকে সেই ঐতিহ্যের অগ্নিশিখা সামনে টেনে নিয়ে গেছেন শেন ওয়ার্ন।

অনেকেই দাবী করেন, ওয়ার্ন সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার। আবার অনেকে মনে করেন, নিজের সময়েরই সেরা স্পিনার নন এই স্বর্ণকেশি অস্ট্রেলিয়ান। কেন? কারণ, ওয়ার্নের সময়ই বিশ্ব আরেক ক্লাসিক স্পিনার দেখেছে, তিনি হলেন স্বয়ং মুত্তিয়া মুরালিধরণ।

দু’জনের মধ্যে কে এগিয়ে? – এটা ওই সময়ের খুব আলোচিত বিতর্ক। আজো আছে এর রেশ। দু’জনের বিপরীতেই খেলা ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ব্রায়ান লারা এই ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘যদি আমাকে বলা হয় যে, তুমি প্রতিদিন ওয়ার্নের বোলিং মোকাবেলা করবে, আমি রাজি আছি। কারণ, আমি জানি প্রথম বল থেকেই আমি ওয়ার্নের বল ব্যাটের মাঝখানে লাগাতে পারবো। কিন্তু মুরালিকে ইনিংসের শুরুতে সামলানো ভয়ংকর কঠিন ব্যাপার। আপনি কখনোই জানবেন না যে ওর হাত থেকে কি বেরোচ্ছে! অবশ্য আপনি যদি মুরালিকে ৪০ মিনিট ধরে খেলে ফেলেন তাহলে আপনি বুঝবেন যে মুরালি আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। তখন ওকে খেলে ফেলা খুব সহজ। তবে, ওয়ার্নের ব্যাপারটা একদম ভিন্ন। যত আপনি তাকে খেলবেন ততই আপনি বুঝতে পারবেন যে সে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে। যত সময় যাবে, ততই বুঝবেন আপনার জন্য টিকে থাকাটা কঠিন থেকে আরো বেশি কঠিন হচ্ছে।’

ওয়ার্ন যেমন সর্বকালের অন্যতম সেরা টেস্ট ক্রিকেটার, তেমনি ক্রিকেটের ইতিহাসেরই অন্যতম বিতর্কিত এক চরিত্রও বটে। তবে, বিতর্ক ছাপিয়ে বারবার পারফরম্যান্স দিয়েই জয় করেছেন তিনি। অনেকবারই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) কাছ থেকে ছাড় পেলেও ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের সময় আর পেলেন না। ডোপ টেস্টে পজিটিভ আসায় দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলেন।

ওয়ার্নের বয়স তখন ৩৪। ক্যারিয়ারের শেষ ধরেই নেওয়া যায়। কিন্তু, ৩৬ বছর বয়সে সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি ফিরলেন। আর কি অনবদ্য এক ফেরা হল সেটা! ক্যারিয়ারের বাকিটা সময় আরো ৩৮ টেস্ট খেলেন, উইকেট নেন ২১৭ টি!

ওয়ার্নের ব্যাটিং নিয়ে আলোচনা কম হলেও সেটাও কম কার্যকর ছিল না। দারুণ এক রেকর্ড আছে তাঁর দখলে। লোয়ার অর্ডারে ১৯৯ ইনিংসে ব্যাট করে ১২ টি হাফ সেঞ্চুরিতে ৩১৫৪ রান করেছেন। কোনো সেঞ্চুরি না পেয়েও টেস্টে এর আগে-পরে কেউ তিন হাজারের বেশি রান করতে পারেননি। ২০০১ সালে পার্থে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ৯৯ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।

মাঠে অবিস্মরণীয় সব কীর্তি গড়লেও বিতর্ক কখনোই তাঁকে পেছনে ছাড়েনি। কখনো বান্ধবী, কখনো নেশা, ক্যাসিনো এসবে তিনি ডুবে থাকতেন। সেটা খেলোয়াড়ী জীবনেও যেমন ছিল, তেমনি মাঠ ছাড়ার পরও ছিল – ছিল জীবনের শেষ অবধি। শেন ওয়ার্ন কখনোই বদলাননি আসলে, – না শিল্পে, না চরিত্রে, না পেরেছেন অনিয়ন্ত্রিত জীবনটায় লাগাম দিতে। মাত্র ৫২ বছরেই জীবন নদীর ওপারে চলে যাওয়া রহস্যশিল্পীর জীবনের শেষটাও বিরাট এক রহস্যই হয়ে থাকলো।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...