সাইমন ক্যাটিচ যখন ক্যারিয়ারের সেরা সময় পাড় করছিলেন তখনই হঠাৎ অস্ট্রেলিয়া দল তাঁকে বিদায় জানালো। সেই বিদায় নিয়ে জল ঘোলাও হয়েছে অনেক। ব্রেট লি বলেছিলেন ক্যাটিচ নাকি অজিদের সেরা টেস্ট অধিনায়ক হতে পারতেন। ব্যাট হাতে দুরন্ত গতিতে ছুটতে থাকা ক্যাটিচের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে হঠাৎই দাড়ি বসিয়ে দেয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার পেশাদার ক্রিকেট ইতিহাসের পেশাদারিত্বের ঘাটতি দেখাগিয়েছিল সাইমন ক্যাটিচের বেলাতেই।
ক্রিকেটে ব্যাটিং সৌন্দর্য্যের যারা প্রতিনিধিত্ব করেন তাঁদের দলে ক্যাটিচ হয়তো পড়বেন না। তবে অসুন্দর টেকনিক কিংবা দুর্বলতা নিয়েও কী করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে রান বের করতে হয় সেটা খুব ভালো করে জানতেন। যত দিন কাটিয়েছেন ততই নিজের দুর্বলতাকে নিজের শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন।
বয়সের সাথে সাথে ব্যাটের ধারটাও যেন বেড়েই চলেছিল ক্যাটিচের। শেষ বেলায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া আরেকটু পেশাদারিত্ব দেখালে হয়তো দেশটির সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যানদের একজন হতে পারতেন। কিংবা ব্রেট লি’র কথামত দেশটির সেরা অধিনায়কও হতে পারতেন।
১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট একাডেমির স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। সে বছরই দেশটির প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষিক্ত হন। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে করেছিলেন এক হাজারের বেশি রান। এর পুরষ্কার হিসেবে ১৯৯৭ সালে শ্রীলঙ্কা সিরিজের জন্য অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পান। তবে সেবার চিকেন পক্সের কারণে শেষ মুহুর্তে আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যাত্রাটা শুরু হয় না। এরপর আবার কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয় আরেকটা সুযোগের জন্য। ২০০০-০১ মৌসুমে করলেন ১২৮২ রান।
অবশেষে ২০০১ সালে অ্যাশেজ সিরিজের দলে আবার ডাক পেলেন এই ব্যাটসম্যান। নিজের অভিষেক ম্যাচে ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নেমে করেছিলেন ১৫ রান। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে আর ব্যাট করারই সুযোগ পাননি। দুঃখজনক ভাবে এই একটু সুযোগকে যথেষ্ট মনে করেছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই ম্যাচের পর আবার দল থেকে বাদ পড়েন ক্যাটিচ।
আবার প্রায় ২ বছর পরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ডাক পান তিনি। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে করেছিলেন ৫২ রান। সেই টেস্টে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন ক্যাটিচ। তবে ব্যাট হাতে নয়। সেই ম্যাচে বল হাতে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। এরপর নিজের প্রথম সেঞ্চুরির জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
ভারতের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়াকে হারের মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলেন ক্যাটিচ। সেই ম্যাচে শচীনের ডাবল সেঞ্চুরিতে ৭০৫ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করিয়েছিল ভারত। জবাবে ব্যাট করতে নেমে অজিরা করে ৪৭৪ রান। এর পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ক্যাটিচের। সেই ম্যাচেই করেছিলেন নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। ১৬৬ বলে ১২৫ রানের সেই ইনিংসে ভর করেই ম্যাচ ড্র করতে পেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। এছাড়া ভারতের স্পিনারদের যেভাবে খেলেছিলেন তাঁর জন্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন সেই সময়।
তবে ২০০৫ সালে অফ ফর্মের কারণে আবার অস্ট্রেলিয়া দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। এরপর ২০০৮ সালে আবার যখন ফিরেছিলেন তখন নিজের সেরাটা নিয়েই এসেছিলেন। ২০০৮-২০১০ এই তিন বছর ক্যারিয়ারের সেরা সময় পাড় করেছেন।
২০০৮ সালে ৫৬ গড়ে করেছিলেন এক হাজারেরও বেশি রান। এই বছর তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল চারটি সেঞ্চুরি। ২০০৯ সালেও ৪৮.৩০ গড়ে করেছিলেন ১১১১ রান। ২০১০ সালেও প্রায় ৪৮ গড়ে রান করেছেন। সেই বছরও তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল দুটি সেঞ্চুরি।
সেই সময় অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার হিসেবে সবার আগে ক্যাটিচের নামই আসতো। ওপেনার হিসেবে যেই ৩৩ টি টেস্ট খেলেছেন সেখানে রান করেছেন প্রায় ৫০ গড়ে। এছাড়া ৩ নম্বরে নেমে খেলা ৩ টেস্টেও করেছেন ২৫৯ রান। সবমিলিয়ে অজিদের হয়ে ৫৬ টেস্ট খেলা সাইমন ক্যাটিচ ৪৫.০৩ গড়ে করেছেন ৪১৮৮ রান। টেস্টে তাঁর ঝুলিতে আছে মোট ১০ টি সেঞ্চুরি, যার মধ্যে ৮ টিই এসেছে ওপেন করতে নেমে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে ক্যারিয়ারে শেষ তিন বছরে ৫০ এর বেশি গড়ে রান করেছেন। এই তিন বছরেই তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ৮ টি সেঞ্চুরি। তবুও ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা টেস্টটাই তাঁর ক্যারিয়ের শেষ টেস্ট ম্যাচ হয়ে রইলো। এরপরের সিরিজে তাঁকে ছাড়াই টেস্ট দল ঘোষণা করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। সেই সময় এর কারণ হিসেবে বলা হয় ২০১৩ সালের অ্যাশেজ সিরিজ মাথায় রেখেই তাঁর দল সাজিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন না ২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্যাটিচ পারফর্ম করতে পারবে।
অথচ এরপরেও অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট ও কাউন্টি ক্রিকেটে নিজের রানের ধারা বজায় রাখেন ক্যাটিচ। ওদিকে ২০১৩ সালের অ্যাশেজে যখন অস্ট্রেলিয়া ভরাভুবি হলো তখনো সাবেক অনেক ক্রিকেটার নিন্দা জানিয়েছিলেন ক্যাটিচকে বাদ দেয়ার জন্য। এমনকি সেই সময়েও কাউন্টি ক্রিকেটে রানের পর রান করে যাচ্ছিলেন ক্যাটিচ। তবুও ক্যাটিচকে আর টেস্ট দলে ডাকেনি অস্ট্রেলিয়া।
ওদিকে ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচের পর নাকি মাইকেল ক্লার্কের সাথে তর্কে জড়িয়েছিলেন ক্যাটিচ। ২০১০ সালে যখন বাদ পড়েন তখন সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, তাঁর এই বাদ পড়ার পিছনে নাকি অন্য কারো ষড়যন্ত্রও আছে। বলেছিলেন তাঁর বাদ পড়ার পিছনের ষড়যন্ত্র বুঝতে কাউকে আইনস্টাইন হবার প্রয়োজন নেই। কারণটা সবাই বোঝে।