একটা সময় প্রোটিয়ারা শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধেই খেলবে, দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার এমন ন্যক্কারজনক ঘোষণা দিয়েছিল। দেশের সরকারের এমন বর্ণবাদ নীতির কারণে ১৯৭০ সালে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকে স্থগিতাদেশ প্রদান করে। ২১ বছর তারা বিশ্ব ক্রিকেটের অঙ্গনে নিষিদ্ধ ছিল।
এর ফলে, গ্রায়েম পোলক, ব্যারি রিচার্ডস, মাইক প্রোক্টরের মত প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অ্যালান ল্যাম্ব, রবিন স্মিথের মত উদীয়মান ক্রিকেটাররাও অভিবাসিত হয়ে ইংল্যান্ড এবং কেপলার ওয়েসেলস অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলেছেন।
লুকিয়ে ইংল্যান্ডে খেলতে হয়েছিল বাসিল ডি অলিভিয়েরাকেও। ইংল্যান্ড দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তাঁকে ইংল্যান্ড দলে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু গায়ের রঙ সাদা নয় বলে তাঁকে দল থেকে বাদ দেবার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা দাবি জানায়। কিন্তু ইংল্যান্ড তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। শেষ পর্যন্ত সফর বাতিল হয়। আর এর চেয়েও বড় ব্যাপার দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট নির্বাসনে যায়।
১৯৭০ সালের ১০ মার্চ সে সময় নিজেদের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৯১ সালের ১০ নভেম্বর আজকের এই দিনে ২১ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর মাঠে ফিরেছিল প্রোটিয়ারা। একজন কালো মানুষের অনুরোধেই আবার ক্রিকেটে ফেরার সুযোগ পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা। যিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি।
২১ বছর পর প্রথমবারের মত ১০ নভেম্বর, ১৯৯১ সালে ভারতের বিপক্ষে কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরে দক্ষিণ আফ্রিকা।
মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের ভারতের বিপক্ষে এই ম্যাচে ২৯ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন অ্যালান ডোনাল্ড। যদিও ভারতের কাছে এই ম্যাচ তারা ৩ উইকেটে হেরে যায় , হাফ সেঞ্চুরি ও এক উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হন স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকার। কিন্তু তবুও মাঠে ফেরাটা তাদের জন্য খুবই স্বস্তিদায়ক ছিল।
অধিনায়ক ছিলেন ক্লাইভ রাইস। বলা হয় টেস্ট না খেলেও ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডার তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২৬ হাজারের ওপর রান আর ৯৩০ উইকেট পেয়েছিলেন। কিন্তু, আরও অনেক প্রোটিয়া গ্রেটের মত ক্যারিয়ারের সেরা সময়টায় দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেট ছিল নিষিদ্ধ।
সেই ভারত সফরেই তিনটি ম্যাচ খেলেন রাইস। সেই শুরু, সেই শেষ। সেবার বলেছিলেন, ‘চাঁদে দাঁড়িয়ে নীল আর্মস্ট্রংয়ের কেমন লাগছিল, সেটা বুঝতে পারছি।’
গোয়ালিওরে দ্বিতীয় ওয়ানডেটাও জেতে ভারত। এক ম্যাচ হাতে রেখেই জিতে নেয় সিরিজ। তবে, দিল্লীর শেষ ম্যাচটা হারে। অধিনায়ক হিসেবে জয় দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয় ক্লাইভ রাইসের।
পরের বছর বিশ্বকাপও খেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। আর বিশ্বকাপে খেলেই সবাইকে চমকে দেয়। চলে যায় সেমিফাইনালে। তবে, সেমিফাইনালে বিচিত্র এক ঘটনার জন্ম হয়। জয়ের জন্য যখন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ১৩ বলে ২২ রান দরকার তখন নামে বৃষ্টি।
কিন্তু, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে বৃষ্টি থামলে অদ্ভুত এক লক্ষ্য পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ১ বলে করতে হবে ২২ রান। আর ফাইনালে যাওয়া হয় না দক্ষিণ আফ্রিকার। এরপর আজ অবধি কোনো বিশ্বকাপেরই ফাইনাল খেলতে পারেনি তাঁরা।
কে জানে, নিয়তিই হয়তো কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে অবমাননার প্রতিশোধ নিচ্ছিল। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পরও প্রোটিয়া দলে কোনো কৃষ্ণাঙ্গের ঠাঁই পেতে পেতে কেটে যায় ছয় বছরেরও বেশি সময়। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় দলে অভিষেক হয় মাখায়া এনটিনির। সেই বছরই প্রথম ও শেষবারের মত কোনো আইসিসি ইভেন্টের শিরোপা জেতে দক্ষিণ আফ্রিকা।