স্পিড মার্চেন্ট বুমরাহ

কথাটা কিছুদিন আগেও উঠেছিল। আবার উঠেছে। উঠবেই, তাতে আমাদের মতো এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে যাওয়া মানুষদের যতই আপত্তি থাক না কেন। মনে পড়ে শচীন–সঞ্জয়কে নিয়ে আরও একবার ক্রিকেট দুনিয়া সগরম উঠেছিল। গাভাস্কারের উত্তরসূরি কি তাহলে এসে গেল ভারতের ক্রিকেটে?

প্রশ্নটা শুনে জোর খেপেছিলেন কপিল। প্রশ্নকর্তাকে বলেছিলেন, ওদের এখন ছেড়ে দিন। বছর দশেক খেলুক, তারপর না হয়।

সেদিন কিন্তু ছেড়ে দেওয়া হয় নি শচীনদের। পরবর্তীকালে সঞ্জয় নিজের প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হলেও সচিন প্রমাণ করেছিলেন তুলনায় ভুল কিছু ছিল না। এবার তুলনা উঠছে জাসপ্রিত বুমরাহর সঙ্গে কপিল দেবের। বুমরা কি চিরশ্রেষ্ঠ ভারতীয় পেসার?

সংখ্যা তো সেদিকেই নির্দেশ করছে। দ্রুততম ১৫০ উইকেট, দুরন্ত গড়, আগুনে গতি, দেশে-বিদেশে সাফল্য – আর কি চাওয়ার আছে? পেস সহায়ক উইকেট না পেয়েও ইংল্যান্ডের ‘বাজবল’ রথের অগ্রগতি নিজের কাঁধের জোরে আটকে দিয়েছেন। এবং গতকাল খবর পেলাম বিশ্বের প্রথম বোলার হিসেবে তিনটে ফরম্যাটেই এক নাম্বার স্থান দখল করেছেন বুমরা। সুতরাং না মেনে উপায় কি যে ‘জসসি জ্যায়সি কোই নহি’?

গত কয়েক মাসে এই নিয়ে তৃতীয় বার কপিলের সঙ্গে বিভিন্ন ক্রিকেটারের তুলনা উঠল। প্রথম, ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবিক ইনিংস। কপিলের ১৭৫ কি এর চেয়েও ভালো ছিল?

দ্বিতীয়, হেডের ধরা রোহিতের ক্যাচটার কি কপিলের ধরা ভিভের ক্যাচের সঙ্গে তুলনা করা যায়? অনেকের মতে সেদিন রোহিত উইকেটে আরও ওভার দশেক টিকে গেলে বিশ্বকাপ ফাইনালের ফল পাল্টে যেতেই পারত। এবং এখন – শ্রীনাথ বা জাহিরের থেকে না হয় মেনে নেওয়া গেল কপিল এগিয়ে ছিলেন কিন্তু বুমরাহ?

গড়, স্ট্রাইক রেট, গতি – সবেতেই তো দেখা যাচ্ছে তিনি কপিলের চেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে। সঙ্গে যোগ করুন ফাস্ট বোলিঙের ব্ল্যাক ম্যাজিক– রিভার্স স্যুইং। নাহ, এবার মনে হয় হারিকেনকে বুম বুম’এর জন্যে জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে।

এটাই কিন্তু হওয়া উচিৎ। এখনও যদি ৪০ বছর আগের এক ফাস্ট বোলার(অনেকেই হয়ত আপত্তি জানাবেন, কপিল আবার ফাস্ট হলেন কবে? আচ্ছা, মিডিয়াম পেসারই সই।

যদি একটা ক্রিকেট পাগল দেশের সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারের শিরোপা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ান তাহলে তো ধরে নিতে হবে দেশের ক্রিকেট থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রতিভা এসে পুরনো কে স্থানচ্যুত করবেন এটাই তো দস্তুর। ঠিকই। আমার মেনে নিতে খুব একটা আপত্তিও নেই। শুধু একটা জায়গায় সামান্য খটকা রয়েছে। সেটা মিটে গেলেই।

ধরা যাক দু’জন দৌড়বীরকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রথমজন প্রমাণ করে ফেলেছেন তিনি স্প্রিন্টে এগিয়ে। এখানে তিনি যদি ১০ এর মধ্যে ৯ পান, অন্যজন বড়জোর ৭.৫ পাবেন। কিন্তু একটু লম্বা রেস হলে? ধরুন ইনিংসে ৪০ ওভার বল করতে হোল। অথবা পরপর ৬টি টেস্ট খেলতে হল ভারতের মাটিতে। কী বললেন?

সময় বদলাচ্ছে, সময়ের সাথে সাফল্যের পরিভাষাও বদলাবার সময় এসেছে? ঠিকই তো! আমাদের ছেলে-মেয়েরা কি আর আমাদের মতো হেঁটে বা সাইকেলে চেপে স্কুল কলেজ যায় নাকি পেনের রিফিল শেষ হলে দোকানে গিয়ে রিফিল কিনে আনে? বা চটি ছিঁড়ে গেলে সেফটি পিন লাগিয়ে কয়েক দিন চালিয়ে নেয়?

আমাদের অনেকেরই মতো আজ ভারতের ক্রিকেট দলের আজ সামর্থ্য রয়েছে নিজের প্রধান স্ট্রাইক বোলারকে দিয়ে ৪ ওভারের ছোট ছোট স্পেলে বল করানোর; একটা টেস্টে অসাধারণ সাফল্যের পর বিশ্রাম দেওয়ার। একজন স্ট্রাইক বোলারের কেয়ার এভাবেই তো নিতে হবে। তাতে সেই বোলারের সাফল্য খাটো হবে কেন?

খুব যুক্তিযুক্ত কথা। বেশ, আমি ক্রাইটেরিয়া বেশ কিছুটা শিথিল করে দিচ্ছি। না, ৪৩৫ টেস্ট উইকেট নয়, ক্যারিয়র শেষে ৭০ টেস্টে অন্তত ৩০০ উইকেট দেখতে চাই আপনার ঝুলিতে। ২৫এর কম গড়ে। এটা কি খুব বেশি চাওয়া হয়ে যাচ্ছে ভারতের চিরশ্রেষ্ঠ পেসারের কাছে থেকে?

আমি কিন্তু অপেক্ষা করতে প্রস্তুত। আপনাদেরও করা উচিৎ। কোনো নতুন প্রতিভা যদি আজ ৬০এর গড়ে হাজার ছয়েক রান করে ফেলে, তাকে কি আপনারা সচিনের চেয়ে বেটার ব্যাট হিসেবে মেনে নেবেন? নাকি আরও কিছুদিন অপেক্ষা করবেন। তাহলে?

বিশেষ একটা কারণে আমি অসম্ভব খুশি বুমরার উত্থানে। ভারত– পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা টেস্ট বা একদিনের টিম নিয়ে আলোচনা হলেই আমরা ধরে নিতাম ব্যাটিংয়ে আমরা এগিয়ে, বোলিংয়ে পাকিস্তান। এবার বোধহয় বোলিঙেও কপিল– বুমরা – শ্রীনাথ– জাহির – কুম্বলে– আশ্বিন – হরভজন– বেদি – প্রসন্ন– চন্দ্রদের লাইন আপ ইমরান– ফজল – সরফরাজ- আকরাম – ওয়াকার– শোয়েব – আসিফ– কাদির – সাকলাইনদের চেয়ে পেছিয়ে থাকবে না।

নিজেকে ফিট রাখুন জাসপ্রীত। এবং তেকাঠি ধ্বংসের ট্র্যাডিশন ভবিষ্যতেও চলতে থাকুক। একজন ভারতীয় ফাস্ট বোলার আজকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠের স্বীকৃতি পাচ্ছে, এটা শুধু আমাদের নয়, স্বয়ং কপিলের কাছে যে কতটা তৃপ্তির সংবাদ, সেটা সম্ভবত বলে বোঝানো সম্ভব নয়।

আপনাকে যখন প্রথম দেখি তখন কল্পনাও করতে পারি নি যে এই অকওয়ার্ড বোলিং অ্যাকশন নিয়ে আপনি এতটা উঠে আসতে পারবেন। অবশ্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের ভুল প্রমাণ করার জন্যেই তো চ্যাম্পিয়নদের জন্ম। আমরা এবার চাই খুব তাড়াতাড়িই যেন আপনি আমাদের মনের অবশিষ্ট সন্দেহও দূর করে ফেলতে পারেন। শুভেচ্ছা রইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link