সাধারণত কোন ক্রীড়াবিদ গোল করতে পারলে, রান নিলে-উইকেট নিলে কিংবা ম্যাচ জিতলে প্রশংসা পেয়ে থাকেন। কিন্তু মাঠের কার্যক্রম ছাড়াও কিছু খেলোয়াড়ের প্রশংসনীয় আরো অনেক দিক রয়েছে। অনেক বৈশ্বিক তারকা ক্রীড়াবিদরা বিশ্বের সবচেয়ে দাতব্য ব্যক্তিদের তালিকায় আছেন।
তারা স্থানীয়ভাবে এবং বিশ্বব্যাপী মানবকল্যানে নিজেদের অর্থ, সময় এবং প্রভাব ব্যবহার করছেন। জনকল্যাণে নিয়োজিত এমনই কয়েকজন ক্রীড়াবিদদের কথা জানা যাক।
- ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার তিনি। তাঁর খেলোয়াড়ী দিকগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও রোনালদোর মানবিক কাজ নিয়ে খুব একটা জানাশোনা নেই। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তারকা হয়ে ওঠার পর থেকে এইচআইভি, এইডস প্রতিরোধ, ক্রীতদাসপ্রথা, মানবপাচার ইত্যাদি অপকর্মের বিরুদ্ধে একজন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন।
তাছাড়া নিজের জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে তিনি এসবের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতেও ভুমিকা রাখছেন। বর্তমানে সেভ দ্য চিল্ড্রেন, ইউনিসেফ এবং ওয়ার্ল্ড ভিশনের মত মানবহিতৈষী প্রতিষ্ঠানের জন্য শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেন এই পর্তুগিজ স্ট্রাইকার।
২০২০ সালের ২৪শে মার্চ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো পর্তুগালের ৩টি হাসপাতালে ১.০৮ মিলিয়ন ডলার দান করেন, এই অর্থ দেশের কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। এসবের বাইরেও প্রায়ই বিভিন্ন খাতে দান করে থাকেন রোনালদো। এছাড়া নিয়মিত রক্তদান করে থাকেন তিনি।
রোনালদোকে ২০১৫ সালে dosomething.org’s এর ‘অ্যাথলেটজোনগুড’ ক্যাম্পেইনের অধীনে ‘মোস্ট চ্যারিটেবল অ্যাথলেট’ পুরষ্কার প্রদান করা হয়।
- লিওনেল মেসি
প্যারিস সেন্ট জার্মেইতে খেলা লিওনেল মেসি ক্লাব থেকে অবিশ্বাস্য অংকের বেতনভাতা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের স্পনসরশিপ ডিল থেকেও অর্থ পেয়ে থাকেন। তবে মেসি এর সব নিজের জন্য রেখে দেন না। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতই বছরের পর বছর ধরে তিনি জনসেবায় নিজের সময় এবং অর্থ ব্যয় করছেন।
গত মহামারীর সময় ক্লাবের কর্মীদের যাতে পুরোপুরি বেতন পরিশোধ করা যায় সেজন্য মেসি নিজের ৭০% বেতন কমাতে রাজি হয়েছিলেন ৷ এছাড়া করোনা কালে লিওনেল মেসি বার্সেলোনার একটি হাসপাতালে ৫ লক্ষ পাউন্ড এবং তার জন্মভূমি আর্জেন্টিনার একটি হাসপাতালে ৫ লক্ষ পাউন্ড অর্থ সহায়তা করেছিলেন।
দাতব্য কাজের ক্ষেত্রে, লিওনেল মেসি নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশন স্থাপন করেছেন। এটি মূলত দুর্বল শিশু এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রুপগুলোর সাথে কাজ করে। বর্তমান সময়ে এই ফাউন্ডেশনের অধীনে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছেন আর্জেন্টাইন তারকা।
- সেরেনা উইলিয়ামস
টেনিস কোর্টে সেরেনা উইলিয়ামস বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী খেলোয়াড়দের মধ্যে একজন। ম্যাচগুলোর বাইরে তিনি তার বেশিরভাগ সময় দাতব্য কাজে ব্যয় করেন। সেরেনা উইলিয়ামস বর্তমানে ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেন। ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠানটির আফ্রিকা এবং এশিয়াতে আয়োজিত প্রোগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন৷
সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের জন্য স্কুল স্থাপন করার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেন এই টেনিস সুপারস্টার। ২০০৫ সাল থেকে উইলিয়ামস ঘানাতে শিশুদের টিকাদান কার্যক্রমে সহায়তা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
বৈষম্য, অবিচার, চরম দারিদ্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মত বিশ্বব্যাপী সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে কাজ করেন এই আমেরিকান। ‘দ্য সেরেনা উইলিয়ামস ফান্ড’ নামে একটি নিজস্ব দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করেন উইলিয়ামস। এই সংস্থা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করে থাকে।
- সাকিব আল হাসান
বাংলাদেশের ইতিহাসে নি:সন্দেহে সবচেয়ে সম্পদশালী ক্রীড়াবিদ হলেন সাকিব আল হাসান। সর্বশেষ করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় শ্রমজীবি মানুষদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে এবার ‘সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন’ নামে একটি দাতব্য সংস্থা করার ঘোষণা দেন বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার। এর সর্বপ্রথম সহায়তা যায় ‘মিশন সেইভ বাংলাদেশ’ নামের একটি উদ্যোগে। কোভিডের সংকটকালীন সময়ে অ্যাম্বুলেন্সের সেবাও প্রদান করে সাকিবের এই দাতব্য সংস্থা।
এক সাক্ষাৎকারে সাকিব বলেছিলেন, ‘মাগুরার অনেক মানুষ আছে যাদের তিন বেলা খাবার জোগাড় হয় না। থাকার জায়গা নেই। আমার প্রতিষ্ঠানে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ কাজ পেলে অন্তত কিছুটা উপকার হবে।’
- নেইমার জুনিয়র
বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ফুটবলার নেইমার জুনিয়রও মানবদরদী কাজে বেশ সক্রিয়। তার অধিকাংশ মানবিক কর্মসূচি নিজ দেশ ব্রাজিলের উন্নয়নে পরিচালিত হয়েছে। স্বদেশী নাগরিকদের যথেষ্ট পরিমাণে পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্য সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে নিজের জীবনের একটি সময় উৎসর্গ করেছেন নেইমার।
২০১৪ সালে তিনি Waves for Water নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জুটি গড়েছিলেন যা ব্রাজিলের অনুন্নত সম্প্রদায়ের কাছে বিশুদ্ধ পানি আনতে কাজ করে। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে কোভিড -১৯ মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করার জন্য ইউনিসেফ এবং প্যারিস সেইন্ট জার্মেনকে ৯৫০,০০০ ডলার দান করেছিলেন ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার।
- সার্জ ইবাকা
এনবিএ খেলোয়াড় সার্জ ইবাকা বেড়ে উঠেছেন কঙ্গোতে। তাই নিজের ক্যারিয়ারের পাশাপাশি কঙ্গো প্রজাতন্ত্র এবং বিশ্বের অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তা করতে বেশ ইতিবাচক তিনি।
স্থানীয়ভাবে তার নিকটবর্তী টরন্টো এলাকা এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিশুদের সাহায্য করার জন্য ইবাকা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এছাড়া তিনি ‘সার্জ ইবাকা ফাউন্ডেশন’ নামের একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন সংস্থাটি কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের ব্রাজাভিলে একটি ত্রাণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছিল।
সংস্থাটি প্রায় ৮০ টন খাদ্য সংগ্রহ করেছে, যা এই অঞ্চলের ৮০০০ পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ৷ আর এই সংগঠনের মূল কাজ শিশুদের একটি সফল ভবিষ্যতের পথ দেখানো। লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা শিশুদের পর্যাপ্ত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা প্রদান করে থাকে। এরা ছাড়াও আরো অনেক অ্যাথলেট মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ সাহায্য করে থাকেন।
ক্রীড়া জগতকে দেখা হয় বিনোদন মাধ্যম হিসেবে। ক্রীড়াবিদরা তাই হয়ে ওঠে সাধারণ বিনোদনদাতা। কিন্তু কখনো কখনো এরাই জীবনের গান গায়, বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। তাদের মাঠের নিপুণতার পাশাপাশি মাঠের বাইরে তাদের নি:স্বার্থ মানবপ্রেম নিয়েও প্রশংসা করা উচিত।