মরুর বুকে অন্য রাবণের দেশ

ভবিষ্যতটাও এমন আলোকিত হোক, মাঠে ও মাঠের বাইরে। আলো আসুক এই নবীন লঙ্কানদের হাত ধরেই। হয়তো এই দলটায় লাসিথ মালিঙ্গা, কুমার সাঙ্গাকারা বা সনাথ জয়াসুরিয়া মত তারকা নেই - কিন্তু এগারো জন এমন লড়াকু খেলোয়াড় আছেন যারা নিজেদের দিনে কাঁধে কাধ মিলিয়ে খেলতে জানেন, জিততে জানেন।

শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অবস্থা তো কমবেশি সবারই জানা। রীতিমতো লঙ্কাকাণ্ড চলছে বটে। হতাশা, কারফিউ, আন্দোলন, পাওয়ার কাট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার বোঝা মাথায় নিয়ে সবশেষে দেশটি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হলো। শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের জন্য যে এই সময়টা কতটা কঠিন তা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু, মজার ব্যাপার হলো ক্রিকেটের আশ্চর্য ক্ষমতা আছে সব মানুষকে এক কাতারে দাড় করিয়ে দেয়। সব কিছু ভুলে গিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য ক্রিকেটের দুনিয়ায় মগ্ন হতে বাধ্য যে কোন ক্রিকেট প্রেমী। তা সে যেই অবস্থানেই থাকুক না কেন।

সেই সময়ের মধ্যেও ক’দিন আগে শ্রীলঙ্কার সাথে খেলে আসলো অস্ট্রেলিয়া দল। যদিও, চলমান আর্থিক অনটন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এতো ঘটনার মধ্যে শ্রীলঙ্কায় সিরিজ খেলতে আসতে দ্বিধাতেই ছিলেন অজিরা।

শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের (এসএলসি) আশ্বাসে অবশেষে খেলতে রাজি হয়েছিল। খেলেছিল শ্রীলঙ্কার মাটিতে। নিজেদের হারানো সময় খুঁজে ফেরা লঙ্কান দলটা নিজেদের মাটিতে তখন বিস্ময়ই সৃষ্টি করেছিল। অজিদের হারিয়ে ওয়ানডে সিরিজটা জিতে নিজেদের করে নেয় তাঁরা।

তবে, বড় বিস্ময়টা জমা থাকলো যেন এশিয়া কাপের জন্য, যে এশিয়া কাপটা আদতে হওয়ার কথা ওই শ্রীলঙ্কায়। কিন্তু, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে সরিয়ে আনা হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এশিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াইয়ের শুরুটা হয়েছিল বিপদ দিয়েই। নব শক্তি আফগানদের বিপক্ষে অসহায় আত্মসমর্পন করে শ্রীলঙ্কা।

কিন্তু, না সেখানেই হারিয়ে যায়নি লঙ্কান সিংহরা। এরপর বাংলাদেশকে হারিয়ে তাঁরা নিশ্চিত করে সুপার ফোর। সেখানে শুরুতেই আফগানদের হারিয়ে প্রতিশোধ নেয় লঙ্কা বাহিনী। শুরু হয় আসল খেলা। প্রতিপক্ষ এবার ভারত। সেখানে শ্রীলঙ্কা দল আরো ভয়ানক। প্রথমে টস জিতে শুরু। এরপর ভারতের রানটাও রাখা গেল সহ্য সীমার মধ্যে। জবাবে উদ্বোধনী জুটিতেই লঙ্কানরা তুলল ৯৭ রান। এরপর ১৩ রানের মধ্যে চারটা উইকেট টপ টপ করে পড়লেও তাঁরা পিছপা হয়নি। ভারতকে বাড়িতে পাঠিয়েই মাঠ ছেড়েছে, শেষ ওভারের লড়াইয়ে জিতেছে।

দেশের এই চরম দু:সময়ে এইটুক প্রাপ্তি কম নয়। আনন্দ ছড়িয়ে গেছে জনমানুষে। কিছু সময় নাগরিকরা এইই ভেবে বুকে আশা বাধবেন এই বুঝি সব স্বাভাবিক হয়ে গেল!  ক্রিকেট তাঁর নিজস্ব ছন্দেই শ্রীলঙ্কানদের সব ভুলিয়ে, খুশির জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছে। সংকটের ভাবনাকে ছাপিয়ে সত্যিকারের হাসি এবং সুখী আলিঙ্গন জয়ী হয়েছে।

ম্যাচটা জিতল শ্রীলঙ্কা। এশিয়া কাপের ফাইনালে জায়গাটা প্রায় করেই ফেললো। ডাগ আউটে বসা সবাইকেও ছুয়ে গেল সেই বিজয়ের রেশ। এই বিজয়টা এতটাই প্রবল যেন ফিরে আসলো ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মৃতি।

সেই লড়াইয়েও যেমন একটা আন্ডারডগ দল হারিয়ে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে, এবারও তাই হল, শ্রীলঙ্কার কাছে হারলো ভারত। পুরো স্টেডিয়ামকেই ছুঁয়ে গেল সেই উচ্ছ্বাস। এ যেন অর্থনৈতিক ভাবে ক্লান্ত কিংবা দেউলিয়া এক শ্রীলঙ্কা নয়, রীতিমত উৎসবে মাতোয়ারা এক রাবণের দেশ।

ক্রিকেট কেবল একটি খেলাই নয়। ক্রিকেটের সাথে আবেগ, দেশপ্রেম, বন্ধুত্ব, হাসিকান্না ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শ্রীলঙ্কা জ্বালানির অভাব, পাওয়ার কাট, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝে যতই আঁধারে নিমজ্জিত থাকুক না কেন, জয়ের আনন্দের উজ্জ্বলতা আলোকিত করেছে পুরোটা দ্বীপজুড়ে।

ভবিষ্যতটাও এমন আলোকিত হোক, মাঠে ও মাঠের বাইরে। আলো আসুক এই নবীন লঙ্কানদের হাত ধরেই। হয়তো এই দলটায় লাসিথ মালিঙ্গা, কুমার সাঙ্গাকারা বা সনাথ জয়াসুরিয়া মত তারকা নেই – কিন্তু এগারো জন এমন লড়াকু খেলোয়াড় আছেন যারা নিজেদের দিনে কাঁধে কাধ মিলিয়ে খেলতে জানেন, জিততে জানেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...