ব্রিটিশ কোচ স্টিভ রোডস; বাংলাদেশের ক্রিকেটে তাঁর অধ্যায় খুব সামান্য দিনের। এলেন, দেখলেন, জয় করলেন – এটাই তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আদর্শ উপায়। খুব পরিশ্রমী ও পেশাদার ছিলেন বলে তাঁর সুনাম ছিল। যদিও, দুই বছরের চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর বিদায় হয়।
২০১৯ সালে মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে, লাল-সবুজ দলটির স্বপ্নপূর করতে পারেননি। বিশেষ করে তার কিছু ‘নেতিবাচক’ কৌশলে খেলোয়াড়, ম্যানেজমেন্ট ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বিরক্ত ছিল। বিশেষ করে, বিশ্বকাপ চলাকালে তিনি যেভাবে একাদশ গড়েছিলেন, সেটা অনেকেরই পছন্দ হয়নি।
বাংলাদেশ সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিল বিশ্বকাপ খেলতে। তিনটা ম্যাচ জিতেছিল বটে, কিন্তু সেমিফাইনালের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তাই, বাংলাদেশ ক্রিকেটে স্টিভ রোডস অধ্যায়ের ইতি ঘটে বিশ্বকাপ শেষেই। পরে, বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন দাবী করেছিলেন, কোচের সাথে খেলোয়াড়দের বিরাট ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’ ছিল।
১৯৬৪ সালের ১৭ জুন জন্ম রোডসের। ১৯৮১ সালে তিনি যখন ইয়র্কশায়ারে যোগ দেন, তখন তিনি কাউন্টি ক্রিকেটে ইতিহাসেরই সবচেয়ে কম বয়সী উইকেটরক্ষক বনে যান।
ইংল্যান্ডের হয়ে ১১ টেস্ট, নয়টি ওয়ানডে খেলেছেন রোডস। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ছিলেন। কিন্তু, ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি জাতীয় দলে। তাই, ইংল্যান্ড দলে তাঁর ক্যারিয়ারটা লম্বা হয়নি কখনো।
তবে, প্রায় ২০ বছর ইংলিশ কাউন্টিতে খেলেছেন তিনি। ১৯৯৪ সালে উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারও হয়েছিলেন। ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত উস্টারশায়ারের কোচ ও ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশে আসার আগে জাতীয় দলের কোচ ছিলেন না কখনোই। বাংলাদেশ দিয়েই শুরু।
রোডস বাংলাদেশ ক্রিকেটে যখন এসেছিলেন তখন চারদিকে নানান আলোচনা হলেও খুব তাড়াতাড়ি মন জয় করে নিয়েছেন কোটি ভক্তের। ক্রিকেটের সাথে সম্পর্কটা এতোটাই মধুর ছিলো যে বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে বোঝার কোনো উপায় ছিলোনা তিনি ইংল্যান্ডের মানুষ!
তিনি মূলত মন জয় করেছিলেন, তাঁর পরিশ্রম দিয়ে। তিনি জাতীয় দলের দায়িত্বের বাইরেও অনেক কাজ করেছেন। আর এর পুরোটাই নিজের আগ্রহে। তিনি নিয়ম করে ঘরোয়া ক্রিকেটের খেলা দেখেছেন। দেশের ভেতরে বয়সভিত্তিক দলের খেলা কিংবা ‘এ’ দলের ম্যাচে ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি।
তিনি ‘এ’ দলের খেলা দেখতে দেশের বাইরে চলে গেছেন এমন নজীরও আছে। তিনি আয়ারল্যান্ডের মাটিতে ‘এ’ দলের সফর দেখতে গিয়েছিলেন। নিজের কাজের ব্যাপারে তিনি কতটা সিরিয়াস ছিলেন, সেটা এখন থেকেই স্পষ্ট ছিল।
রোডসের উদ্দেশ্যটা পরিস্কার ছিল, বাংলাদেশ ক্রিকেটের পাইপলাইনে কি আছে, আর কি নেই সেই ব্যাপারটা বুঝতে চেয়েছিলেন। সেটা বোঝা থাকলে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা সাজানোটা যে সহজ হয় সেটা তো না বলে দিলেও চলে।
তার সামর্থ্য খুব সীমিত ছিল, সেটা বোঝা গিয়েছিল। তবে, সীমিত সামর্থ্য দিয়েও নিজেকে উজার করে দিয়েছিলেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা সাফল্য আসে তারই সময়। আয়ারল্যান্ডের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশের। নিজেদের ইতিহাসে সেটা বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র ট্রফি। লম্বা অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফিতে হাত রাখেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।
এই অর্জনের জন্য হলেও, স্টিভ রোডকে মনে রাখার কোনো বিকল্প নেই। তাঁর কৌশলগত যত সমস্যাই থাকুক না কেন, দেশের ইতিহাসের সফল কোচদের একজন তাকে বলাই যায়। তবে, একটা বিষয় খুবই সত্য যে, বড় আসরে প্রভাব রাখতে হলে সাধারণ কোচের চেয়েও অনেক বড় কিছু করে ফেলতে হয়। স্টিভ রোডসের মধ্যে সেই দক্ষতা ছিল না। সেজন্য কুঁড়িতেই
আর তাঁর ব্রিটিশ চরিত্রটাও একটা সমস্যা ছিল। কারণ, ব্রিটিশরা স্বভাবতই ভাবলেশহীন। ক্রিকেট তাঁরা ভালবাসে। কিন্তু, উপমহাদেশের মত এই খেলাটাকে তাঁরা ধ্যান-জ্ঞান মানে না। তাই, স্টিভ রোডসও বাংলাদেশের ক্রিকেট, ক্রিকেটার ও বিসিবির মানসিকতা বুঝতে ব্যর্থ হন পুরোপুরি। আর এটাই তাঁর বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।