চিলির বিপক্ষে ফ্রি-কিকে দারুণ এক গোল দিয়ে ফ্রি-কিক গোলে রোনালদোকে পেছনে ফেলার পর থেকেই প্রশ্নটা উঠেছে-আচ্ছা মেসিই কি ফ্রি-কিকে সর্বকালের সেরা?
অথচ একটা সময় ছিলো, যখন মেসি একেবারেই নিম্নমানের একজন ফ্রি-কিক টেকার ছিলেন। মোটা দাগে বললে, স্পট কিকেই মেসির কখনো সুনাম ছিলো না।
একটা সময় মেসির চেয়ে রোনালদো এগিয়ে ছিলেন ৩০-৩ ব্যবধানে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নিজের পরিশ্রম আর ইচ্ছাশক্তির জোরে মেসি আজ এগিয়ে। হিসেবটা কিছুটা কমিয়ে যদি কেবলমাত্র গত দশকেই সীমাবদ্ধ করি তাহলে মেসি আরো এগিয়ে। গত দশকে মেসির ৩৪ ফ্রি-কিক গোলের বিপরীতে রোনালদো করেছেন ২০টি। তৃতীয়তে থাকা মিরালেম পিয়ানিচের গোলসংখ্যা ১৬টি।
কিন্তু মেসি কিভাবে বদলে গেলেন? কিভাবে সাধারণ একজন ফ্রি-কিক টেকার থেকে বিশ্বসেরা হয়ে উঠলেন? কী এর পেছনের গল্প?
২০০৫ সালে বার্সেলোনা লা মাসিয়ার তরুণদের জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ছিল সহজ; প্রতিটি কিশোর ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়াবে এবং বলবে ‘আমার নাম মনে রেখো’। প্রায় সবাই আত্নবিশ্বাসের সাথে কাজটি করছিলো। কিন্তু লিওনেল মেসি নামের এক আর্জেন্টাইন তরুণের পালা আসতেই সে এক অদ্ভুত কাজ করলো, সে ক্যামেরাটি বন্ধ করে দিলো।
মেসি তার আগের বছরই বার্সার মূল দলে খেলে ফেলেছেন। মেসি ক্যামেরাটি মাঠের দিকে ঘুরিয়ে একটি ফ্রি কিক নিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে বলটি হাওয়ায় ভেসে বাম প্রান্ত দিয়ে জালে প্রবেশ করে। মেসির সতীর্থরা তো বটেই, মাঠে উপস্থিত থাকা ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে যান। মজার ব্যাপার হলো মেসি তখনো পর্যন্ত তার দলের সেট পিস নিতেন না।
বার্সার যুব দলে মেসির সতীর্থ রজার গিরিবিতের ভাষ্যমতে, ‘লা মাসিয়ায় থাকাকালে মেসি খুব বেশি ফ্রি কিক নেননি। ভিক্টর ওয়াজকেজ এবং জুয়াঞ্জো ক্লাউসিই মূলত ফ্রি কিক নিতেন। মেসি নেবার তেমন সুযোগ পেত না।’
সাবেক লা মাসিয়া প্রধান অ্যালবার্ট বেনাজিসের মতে লা মাসিয়া কখনোই সেট পিসকে প্রাধান্য দেয় না। তিনি বলছিলেন, ‘এটি এমন কিছু যা আমরা কখনোই অনুশীলন করিনি। আমরা মাঝে মাঝে হয়তো দেয়াল দিয়ে ফ্রি কিক নিতাম। কিন্তু পাসিং কিংবা রিসিভিং এর মতো গুরুত্বের সাথে সেটপিস অনুশীলন করতাম নাহ। আমাদের কেবল একবার বলা হয়েছিল বলকে কোথায় বসালে কিছুটা সুবিধা পাবো কিংবা কোন জায়গায় মারলে বলকে হাওয়ায় ভাসাতে সুবিধে হবে। সম্ভবত গুইলের্মো হইওস (সাবেক বার্সা বি কোচ) এই অনুশীলন করাতেন লা মাসিয়ানদের। তবে মেসি ছিল প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা। সে ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা, বলের সাথে সহজাত দক্ষতা ছিল তার। মেসি যখন বার্সায় আসেন তখন থেকেই তিনি আলাদাভাবে ফ্রি কিক অনুশীলন করতেন। লা মাসিয়ায় আমরা তাকে শিখিয়েছি এমন কিছু নয়। এটি তার একটি জন্মগত বৈশিষ্ট্য এবং প্রতিনিয়ত তিনি এই দক্ষতাকে শানিত করে যাচ্ছেন।’
বোঝাই যাচ্ছে, লা মাসিয়ায় থাকতেও মেসির ফ্রি কিক বলার মত কিছু ছিলো না। আর এই বলার মত ব্যাপারটা যোগ হলো আসলে একজন জাদুকরের ছোঁয়ায়।
মেসির ফ্রি কিকের এই উন্নতির পিছনে অবদান রাখার মতো একজনই আছেন, তিনি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তিনি মেসির সেটপিস দক্ষতাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। ২০০৯ সালে মার্সেইতে ম্যারাডোনা মেসিকে এই শিল্প আয়ত্ত্বে আনার কৌশল বাতলে দেন।
ম্যারাডোনার সহকারী ফার্নান্দো সিগনোরি বলেন, ‘একবার দলীয় অনুশীলন শেষে মেসি একা একাই ফ্রি কিক অনুশীলন করছিলেন। তিনি বার কয়েক চেষ্টার পরও সফল হতে না পেরে তিনি চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় তৎকালীন আর্জেন্টিনা কোচ ম্যারাডোনা তাকে কাছে ডাকেন। আমি ডিয়েগোকে আসতে দেখলাম, তিনি মেসির কাঁধে হাত রাখলেন এবং বললেন, ছোট লিও, ছোট লিও। আমার কাছে আসো। এখানে দাঁড়াও এবং আবার চেষ্টা করো। আমি একবার দেখাচ্ছি। শিক্ষক যেভাবে ছাত্রকে শেখায় তিনি সেভাবেই মেসিকে দেখাচ্ছিলেন। তিনি মেসিকে বললেন, বল থেকে পা দ্রুত সরিয়ে নিও না। কারণ নইলে তুমি ঠিক জায়গামতো বলকে মারতে পারবে না। এরপর তিনি (ম্যারাডোনা) নিজেই একটি ফ্রি কিক নিলেন এবং বলটি একেবারে গোলরক্ষকের নাগালের বাইরে দিয়ে জালে প্রবেশ করলো। মেসির চোখমুখে তখন বিস্ময় এবং প্রশংসায় পরিপূর্ণ।’
এরপর থেকেই মেসি নিয়মিত মানব দেয়াল এবং গোলরক্ষককে ভেদ করে গোল দেয়ার শিল্পটিকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ক্যামেরার সামনে মেসির প্রথম ফ্রি-কিক নেয়ার প্রায় পনের বছর কেটে গেছে কিন্তু গিরিবেট এখনো মনে রেখেছেন যেন ঘটনাটি গতকালের।
এখন বিশ্বের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ফ্রি-কিক লিওনেল মেসিই নিয়ে থাকেন, সম্ভবত ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফ্রি কিক টেকার। ম্যারাডোনা অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য মেসির এই উন্নতির পেছনে। কে জানে, হয়তো শিষ্যের অনবদ্য সব কীর্তি দেখে ওপারে বসে থাকা ম্যারাডোনাও মুচকি হেসে ওঠেন, পাশে থাকা কাউকে বলে উঠেন, ‘দেখলে ছেলেটা কি দারুণ ফ্রি কিক নেয়! ওকে আমিই ফ্রি-কিক নেবার তালিম দিয়েছি।’