স্টুয়ার্ট ল: প্রতিভা ছিল, সুযোগ ছিল না

জাতীয় দলে নিজের ক্যারিয়ারটা পূর্ণতা পায়নি। ক্রিকেটকে অনেক কিছু দেবার সামর্থ্য থাকলেও সুযোগের অভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। কে জানে হয়তো  ক্রিকেট কোচ হিসেবে তাই নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করেন স্টুয়ার্ট ল।

বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা কোচ তিনি। তাঁর অধীনেই প্রথমবারের মতো বড় দল হওয়ার সামর্থ্যের জানান দিয়েছিল টাইগাররা। উঠেছিল এশিয়া কাপের ফাইনালে, যদিও পাকিস্তানের কাছে দুই রানের হারে ট্রফি থেকে ফিরতে হয় হাত ছোঁয়া দূরত্বে। কোচ পরিচয়ের আড়ালে অনেকে ভুলে যায় তাঁর ক্রিকেটার পরিচয়ের কথা। নিজের সময়ের অন্যতম কার্যকরী ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। বলছিলাম স্টুয়ার্ট ল’য়ের কথা, দারুণ ব্যাটার ছাপিয়ে যিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বৈশ্বিক কোচ হিসেবে। 

অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের সাগরপাড়ে জন্ম। বাবা গ্র্যান্ট ল ছিলেন ব্রিসবেনের নামকরা ক্রিকেটার, নেতৃত্ব দিয়েছেন স্থানীয় দলগুলোর। বাবাকে দেখেই ক্রিকেটের প্রেমে পড়া, মাত্র দেড় বছর বয়সে হাতে পান নিজের প্রথম ব্যাট। দশ বছর বয়স পেরোনোর আগেই অবশ্য বাবার সতর্কবাণী পেয়েছিলেন।

ছোট্ট ল’কে তাঁর বাবা বলেছিলেন, ‘ক্রিকেটটা যদি খেলতেই হয় তোমার, তবে নিয়ম মেনেই খেলতে হবে।’ ব্যাট কিংবা বোলিং টেকনিকে গলদ কোনোভাবেই বরদাস্ত করতে পারতেন না এই বর্ষীয়ান। ছোটবেলা থেকেই তাই ক্রিকেট ব্যাকরণ মেনেই চোখ ধাঁধানো সব শট খেলতেন তিনি। 

মাত্র ১৫ বছর বয়সে ব্রিসবেনের বয়স ভিত্তিক দলে সুযোগ পেয়ে যান তিনি। সেখানে দারুণ পারফর্ম করার সুবাদে ডাক পান ছোটদের বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে। সেখানেই প্রথম আলোচনায় আসেন শ। ভারতের লেগস্পিনার নরেন্দ্র হিরওয়ানিকে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন ব্যাট হাতে, হাঁকিয়েছিলেন বিশাল সব ছক্কা।

অথচ, মাস তিনেক আগেই অভিষেক সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৬ উইকেট নিয়েছিলেন হিরওয়ানি। পরের মৌসুমেই কুইন্সল্যান্ডের হয়ে শেফিল্ড শিল্ডে অভিষেক ঘটে তাঁর। প্রথম ম্যাচে না পারলেও পরের ম্যাচেই খেলেন ১৭৯ রানের চোখ ধাঁধানো এক ইনিংস। 

অস্ট্রেলিয়া দলে তখন তারকার ছড়াছড়ি। রিকি পন্টিং, ডেমিয়েন মার্টিন, ম্যাথু হেইডেন, মাইকেল বেভান কে নেই সেই দলে। ফলে ঘরোয়াতে ভালো খেললেও জাতীয় দলে কোনোভাবেই সুযোগ মিলছিল না তরুণ ল’র। অবশেষে নিজেকে প্রমাণ করতে কাউন্টি খেলতে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান তিনি। সেখানেই সবচেয়ে বিধ্বংসীরূপে দেখা গিয়েছিল তাঁকে, টেস্ট এবং ওডিয়াই দুই ফরম্যাটেই ছাড়িয়েছিলেন হাজার রানের কোটা।

লর্ডসে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালে অপরাজিত ৮০ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলে এসেক্সকে জিতিয়েছিলেন শিরোপা। তবে তাঁর ইনিংসের মাহাত্ম্য কেবল রান সংখ্যা দিয়ে মাপলে চলবে না, ফাইনালের পাহাড়সম চাপ নিয়েই তিনি খেলেছিলেন অনবদ্য সেই ইনিংস। উইকেটে দারুণ সব স্ট্রোকের পসরা সাজিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখতেন তিনি। ব্যাট হাতে রানের পাশাপাশি মিডিয়াম পেস আর লেগস্পিনের মিশ্রণে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বল হাতে ৬৪ উইকেটও আছে তাঁর। 

এরপর আর তাঁকে উপেক্ষা করার সুযোগ ছিল না অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকদের। ১৯৯৫ মৌসুমে ইংল্যান্ড সফরে অপেক্ষাকৃত তরুণ এক অজি দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। তবে তাঁর জীবনের আক্ষেপ হয়ে থাকবেন ১৯৯৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে হার। সেবার শ্রীলংকার বিপক্ষে হেরে রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় অজিদের।

ফাইনালের এই হার সারাজীবন আক্ষেপে পুড়িয়েছে ল’কে। এর আগের বছরই স্টিভ ওয়াহর ইনজুরির সুবাদে ঘরের মাঠে শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক ঘটে তাঁর। দলের পক্ষে একমাত্র ইনিংসে ব্যাট করে খেলেছিলেন ৫৪ রানের ইনিংস। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য দারুণ খেলার পরও পরের টেস্টেই দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। ফলশ্রুতিতে সেই টেস্টই একমাত্র টেস্ট হয়ে আছে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে। 

১৯৯৯ সালে শেষ বারের মতো অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে দেখা যায় তাঁকে। মিডল অর্ডারে ব্যাট করে ৫৪টি এক দিনের ম্যাচ খেলে এক সেঞ্চুরি আর সাত হাফ-সেঞ্চুরির সাহায্যে ১,২৩৬ রান করেন তিনি। ক্রিকেট ছাড়ার পর কোচিং এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। শ্রীলংকার সহকারি কোচ ছাড়াও দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রধান কোচ হিসেবে।

জাতীয় দলে নিজের ক্যারিয়ারটা পূর্ণতা পায়নি। ক্রিকেটকে অনেক কিছু দেবার সামর্থ্য থাকলেও সুযোগের অভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। কে জানে হয়তো  ক্রিকেট কোচ হিসেবে তাই নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করেন স্টুয়ার্ট ল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link