জাম্বো এক যোদ্ধার নাম
দিনের শেষে তিনি যা অর্জন করেছেন এবং নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন তা কেবলমাত্র তাঁর মতো চরিত্র বলেই সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা কোথায় গিয়ে থামতে হয় তা তিনি জানতেন। অন্যরা যখন অবসর সম্বন্ধে খোঁচা খান, সেখানে দাঁড়িয়ে অধিনায়ক থাকাকালীন যখন চোট পেলেন তখন নিজেই সরে গেলেন, বীরের মত।
ভাঙা চোয়াল, শানিত তরবারির ন্যায় চকচকে একজোড়া প্রত্যয়ী চোখ নিয়ে বোলিং প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন ব্যাটসম্যানের দিকে। বজ্রকঠিন লম্বা হাত থেকে বেরোলো তীক্ষ্ণ, বিষাক্ত, নিজ লক্ষ্যে অবিচল তীর প্রত্যেক বারের মতোই ২২ গজে পড়তেই বল নিজের আচরণ শুরু করলো।
সামান্য স্কিড করলো আর তার পরেই আঘাত হানলো লক্ষ্য বস্তুতে সেটা ব্যাটসম্যানের প্যাডে আঘাত করায় হোক কিংবা ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত কাঠের টুকরোই আঘাত করায় হোক আবার ব্যাটে লেগে সামনে দাঁড়ানো সহযোগীদের তালু-বন্দীই হোক, যত বারই তখন এই ঘটনা ঘটতো চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখা যেত ৬ ফুট ১ ইঞ্চির যোদ্ধার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কঠিন মুখাবয়বের – আমাদের সবার পরিচিত ‘জাম্বো’র।
ক্রিকেট ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ব্যাটসম্যানরা যতগুলো না ম্যাচ জিতিয়েছেন তার থেকে বহু বেশি ম্যাচ বোলাররা জিতিয়েছেন, কিন্তু তারা সবসময় প্রচারের আলোর পেছনে রয়ে গিয়েছেন। তেমনই একজন ক্রিকেটার হলেন অনিল কুম্বলে। নিজের সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটে অসাধারণ সব ব্যাটসম্যানদের মাঝেও বহু ম্যাচ নিজের দক্ষতায় জিতিয়েছেন, পরিসংখ্যান দেখলে হয়তো তা অনেককে লজ্জাতেও ফেলে দিতে পারে। কিন্তু এতকিছুর পরও নিজেকে জাহির করা বা অহংবোধ দেখানো, কোনদিন এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
‘লেগ স্পিন’ হল ক্রিকেটের একটি অসাধারণ সুন্দর এক শিল্প। যে শিল্পকে করায়ত্ত করতে অপরিসীম দক্ষতা, নৈপুণ্য ও ধৈর্য্যের প্রয়োজন। ক্ল্যারি গ্রিমেট, বিল ও’রেইলি, সুভাষ গুপ্তে, আব্দুল কাদির, রিচি বেনো কিংবা শেন ওয়ার্নে মত কিংবদন্তিরা এই অসাধারণ শিল্পকে নিজেদের করায়ত্ত করে পৃথিবীতে তাদের সুবাস ছড়িয়ে দিয়েছেন।
ফ্লাইটের সাথে কব্জির মোচড়ে বলকে ঘুরিয়ে ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়ে স্ট্যাম্পড আউট, কিংবা উইকেটের পেছনে তালু-বন্দী করা অথবা ব্যাটসম্যানকে ক্যাচ তুলে বাধ্য করা, এইসব ক্রিকেটের আদি যুগ হতেই লেগস্পিনারদের প্রধান অস্ত্র ছিল। এরপর আরেক শিল্প গুগলি এসে তাদের আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। কিন্তু অনিল কুম্বলে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করার পন্থাটি নিজের মত করে নিয়েছিলেন।
প্রথাগত লেগস্পিনের ওপর জোর তার কোনদিনও ছিল না আর তাকে উন্নত করবার চেষ্টাও হয়তো করেননি। তার অস্ত্র ছিল উইকেটের বাউন্স আর ‘স্কিড’ করবার ক্ষমতা, টপ স্পিন ও ফ্লিপার। এইসব গুলোই দিয়েই বারবার বিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের উইকেটের সামনে ধরা পড়িয়েছেন। শুরুর দিকে লেগ স্পিনের উপর জোর দিলেও যত সময় গিয়েছে নিজের অস্ত্র গুলো সামনে এনেছেন।
যেকোনো ম্যাচের অবস্থা গুলো ভাল বুঝতে পারতেন। অধিনায়ক হওয়ার পর যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন নিজের ওই গুণ গুলো কাজে লাগিয়েছেন। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন।।ব্যাটসম্যান হিসেবেও নিজের দক্ষতা বারবার প্রমাণ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার ইনিংসগুলো বারবার দলকে অক্সিজেন জুগিয়েছে।
ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর দলে গ্রহনযোগ্যতা সব সময় উপরের দিকেই থাকতো। তাও ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, তিনি থাকলে কি হতো তা পরের কথা কিন্তু একজন ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে খেললে হয়তো একটি আলাদা অনুভূতি থাকতো। বিদেশের মাটিতে উইকেট নিতে পারেন না বলে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে।
কিন্তু, দিনের শেষে তিনি যা অর্জন করেছেন এবং নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন তা কেবলমাত্র তাঁর মত চরিত্র বলেই সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা কোথায় গিয়ে থামতে হয় তা তিনি জানতেন। অন্যরা যখন অবসর সম্বন্ধে খোঁচা খান, সেখানে দাঁড়িয়ে অধিনায়ক থাকাকালীন যখন চোট পেলেন তখন নিজেই সরে গেলেন, বীরের মত।