অসময়ের উপেক্ষায় অনন্ত অপেক্ষা

ভারতীয় ক্রিকেটে তখন স্পিনার মানেই - অনিল কুম্বলে। কুম্বলেকে সরিয়ে দলে জায়গা করে নেওয়ার মতন আকাশ-কুশুম কল্পনা কেউ করতেনও না। এই কুম্বলের ছায়াতলে কেটে গেছে যোশির অমিত সম্ভাবনাময় এক ক্যারিয়ার। যিনি ক্যারিয়ার জুড়ে যা দিয়েছেন কিংবা অর্জন করেছেন - প্রতিভার বিচারে তা বেশ যৎসামান্যই।

বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট। ব্যর্থতা দিয়ে সাদা পোশাকে বাংলাদেশের যাত্রাটা শুরু। ভারতের বিপক্ষে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রথম ইনিংসে বেশ লড়াই করেও ৯ উইকেটের হার নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল স্বাগতিক ছেলেরা। ওই টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে বল হাতে যমদূত হিসেবে হাজির হন বাঁ-হাতি স্পিনার সুনীল যোশি।

প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় উইকেটে নেন ৩ উইকেট। সেই সাথে মোহাম্মদ রফিকের ঘূর্ণি জাদুতে ২৩৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে যখন বিপাকে ভারত – তখনই ব্যাট হাতে ত্রাণকর্তা রূপে হাজির যোশি। ৯২ রানের এক ইনিংসে ম্যাচের চিত্রই বদলে ফেলেন তিনি। বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতের ৯ উইকেটের জয়ে সেদিন ম্যাচ সেরা হন এই স্পিন অলরাউন্ডার।

ভারতীয় ক্রিকেটে তখন স্পিনার মানেই – অনিল কুম্বলে। কুম্বলেকে সরিয়ে দলে জায়গা করে নেওয়ার মতন আকাশ-কুশুম কল্পনা কেউ করতেনও না। এই কুম্বলের ছায়াতলে কেটে গেছে যোশির অমিত সম্ভাবনাময় এক ক্যারিয়ার। যিনি ক্যারিয়ার জুড়ে যা দিয়েছেন কিংবা অর্জন করেছেন – প্রতিভার বিচারে তা বেশ যৎসামান্যই।

মাত্র ১০ বছর বয়সেই ক্রিকেটে পথচলা শুরু। বাবা ভান্ডচার্য যোশী ছিলেন ফুটবলের বড় ভক্ত। ক্যারিয়ারের শুরুতে সুনীল ছিলেন একজন পেসার। কিন্তু বড় ভাই পরামর্শ দিল বাঁ-হাতি স্পিন করতে। সেই টোটকা কাজে লেগে গেল যোশির। পেসার থেকে স্পিনার বনে গিয়ে দেখা পেলেন সফলতার।

গাদাগ টু হুবলি – ৬৫ কি.মি লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন অনুশীলনে যেতেন। কর্ণাটকের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৫ দিয়ে শুরু। এরপর অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব-২২ দলেও বল হাতে দ্যুতি ছড়ান যোশি।

থ্রি ওভালস কেএসসিএ স্টেডিয়ামে একবার অনূর্ধ্ব-১৫ দলের অনুশীলনে ব্যস্ত যোশি। বেশ কিছু সময় ধরে বল করছিলেন তিনি। দূর থেকে যোশির বোলিং মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন সৈয়দ কিরমানি। এই ভদ্রলোককে অবশ্য আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার খুব সম্ভবত প্রয়োজন নেই। ভারতের ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী দলের অন্যতম এই সদস্য যোশির বোলিংয়ে বিমোহিত হয়ে যান। বলেই ফেললেন, ‘এই ছেলের ভবিষ্যত উজ্জ্বল।’

কিরমানির অনুমান মিথ্যে হয়নি। ১৯৯২ সালে হুবলিতে হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয় যোশির। অবশ্য একদম শেষ মূহুর্তেও যোশি জানতেন না তিনি একাদশে আছেন কি-না! টসের একদম আগ মূহুর্তে জানলেন একাদশে তার নামটিও জায়গা পেয়েছে।

বছর দুই পরে ব্যাঙ্গালুরুতে মুম্বাইয়ের বিপক্ষে ১৬০ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে বেশ বিপাকে কর্ণাটক। সেখান থেকে ভাল একটা সংগ্রহ অনেকটাই অকল্পনীয় ব্যাপার। তবে সেটি করে দেখান যোশি। ১১৯ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংসের পথে মেইডেন সেঞ্চুরি তুলে নেন এই অলরাউন্ডার। ওই ম্যাচেই বল হাতে শিকার করেন ৯ উইকেট। যোশির অলরাউন্ড প্রতিভা সেদিন নজরে আসে সবার।

এরও বছর দুয়েক বাদে বিএ পরীক্ষা দিচ্ছেন যোশি। সেবার অবশ্য ব্যাটে-বলে উড়ন্ত ফর্মে ছিলেন তিনি। ৬৬ গড়ে ৫২৯ রান আর বল হাতে ৫২ উইকেট শিকার করেন তিনি। মাঠের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স পাশে রেখে পরীক্ষা নিয়েই তখন তিনি মনযোগী।

মাঝেই রুম সুপারভাইজার প্রবেশ করলেন। যোশীর কানে গিয়ে জানালেন ইংল্যান্ড সফরের জন্য ভারত জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন তিনি। খাতা আর কলমটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড় দিলেন। গাদাগ থেকে প্রথম কেউ জাতীয় দলে খেলবে – এই আনন্দে উদযাপন চলছিল যোশির গ্রামে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক। এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে সুযোগ পান। ব্যাট হাতে লোয়ার অর্ডারে ৪৮ রান আর বল হাতে ৪ উইকেট। ৮৯ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়া ভারতকে সেদিন রক্ষা করেছিলেন যোশি। এরপর দলে আসা যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন তিনি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপেও দলে জায়গা করতে পারেননি এই স্পিন অলরাউন্ডার।

অনিল কুম্বলে দলে সেট থাকায় একাদশে জায়গা করাটা অনেকটা এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার মতন কষ্টসাধ্য ছিল যোশির জন্য। অভিষেকের বছর খানেকের মাঝেই বাদ পড়লেন দল থেকে। হতাশ ছিলেন, কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না; এমন সময় যোশিকে সাপোর্ট দেন ভারতের সাবেক তারকা স্পিনার বিষেণ সিং বেদি। সেখান থেকে আবার উঠে দাঁড়ালেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম করে ফিরলেন জাতীয় দলে।

যোশির নাম আসলে ১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের কথা আসবেই। জিমখানা ক্লাব মাঠে রেকর্ডগড়া বোলিং স্পেলে প্রোটিয়াদের একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ১০ ওভারে ৬ মেইডেনসহ মাত্র ৬ রানে ৫ উইকেট শিকার করেন তিনি! সেসময় এটি ছিল ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা বোলিং ফিগার।

২০০১ সালে ত্রিশ বছর বয়সেই দলে জায়গা হারান যোশি। তরুণ হরভজন সিং আর অভিজ্ঞ অনিল কুম্বলের সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠেননি তিনি। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে গেছেন লম্বা সময়। ১৫ টেস্টে ৩৫২ রান আর বল হাতে নেন ৪১ উইকেট।

অপরদিকে, ৬৯ ওয়ানডেতে ৫৮৪ রান আর বল হাতে শিকার করেন ৬৯ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আছে ৫ হাজারের বেশি রান ও ছয়শোর বেশি উইকেট। ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে জড়িয়েছিলেন কোচিং পেশায়। আক্ষেপ অবশ্যই আছে।

এমন সময়ে তিনি দলে এসেছিলেন যখন সামর্থ্য থাকলেও দেখানোর সুযোগটাই ছিল কম। ভারতের কিংবদন্তি তারকা সুনীল গাভাস্কার, রহস্যময় স্পিনার তকমা পাওয়া সুনীল নারাইন কিংবা প্রোটিয়াদের বিপক্ষে রেকর্ডগড়া স্পেল করা সুনীল যোশি – সুনীল নামধারী যারাই ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসেছেন, বেশিরভাগই কৃতিত্বের ছাপটা স্পষ্টভাবে রেখে গেছেন।

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...