প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির মেলবন্ধন ঘটেছে। যদিও এ প্রাপ্তিতে একদম আনন্দে ভেসে যাওয়ার কিছু নেই, তবুও বিশ্বকাপ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পরিস্থিতি তুলনা করে আমি অন্তত সন্তুষ্ট। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে বাংলাদেশ সুপার টুয়েলভের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত সেমির দৌড়ে টিকে থাকবে বলে কয়জন ভেবেছিলেন? আমাদের খেলোয়াড় ও নীতিনির্ধারকরাই তো ভাবেননি! বিশ্বকাপের প্রাক্কালে খোদ বোর্ড সভাপতিই বলে বেড়িয়েছেন যে, তাঁদের লক্ষ্য পরবর্তী বিশ্বকাপ। দল থেকেও এ বিশ্বকাপকে ঘিরে কোনো লক্ষ্যের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারিনি আমরা।
এর মাঝে মাঠ ও মাঠের বাইরে ঘটেছে নানা বিতর্কিত ঘটনা। এ সবকিছুর পরেও কাগজে-কলমে বাংলাদেশ যে তাঁদের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হিসেবে এবারের মিশনটা শেষ করল, তাতেই আমি খুশি। এখন টিপ্পনী কেটে বলতে পারেন, গ্রুপের ৬ দলের মধ্যে হয়েছে পঞ্চম, জিতেছে মাত্র দুইটা ম্যাচ তাও নেদারল্যান্ডস ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে! তাতেই এত খুশি!
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের চেয়েও এই দুইটা দল বেশি টাচে ছিল এবারের বিশ্বকাপে। নেদারল্যান্ডস প্রথম রাউন্ডে দুইটা ক্লোজ গেইম জিতে সুপার টুয়েলভে আসে। এখানে ছন্দে থাকা জিম্বাবুয়েকে হারানোর পাশাপাশি তো দক্ষিণ আফ্রিকাকে একদম বিদায় করেই বসলেন তাঁরা।
অন্যদিকে জিম্বাবুয়ে গেল কয়েকমাস ধরে এই সংস্করণে রীতিমতো উড়ছে। আমাদের বিপক্ষে সিরিজ জেতার পাশাপাশি বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সুপার টুয়েলভে এসে সেমিফাইনালিস্ট পাকিস্তানকে তাঁরা পরাজিত করেন৷ তাই বাস্তবতার নিরিখে এই দুইটা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে পাওয়া দুইটা জয়কে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, ‘আউট অব দ্য ব্লু’ সেমিতে খেলার সুযোগটা কাজে লাগানো দরকার ছিল বাংলাদেশের। দু:খজনকভাবে সেটা হয়নি। আমরা নিজেরাই তা হেলায় হারিয়েছি।
তাছাড়া সবচেয়ে সফল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাটানোর পরেও মাঠের পারফরম্যান্সে বাংলাদেশের উন্নতির জায়গার অভাব নেই। এমনিতে টোয়েন্টিতে ম্যাচ জেতার জন্য হাতেগোনা দুই-তিনজন পারফর্ম করলেই যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের মতো দলের ক্ষেত্রে এ কথাটা খাটে না। কেননা আমাদের একজন পাওয়ার হিটার নেই, বিশ্বমানের কোনো ব্যাটার নেই, ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো দুই-তিনজন বোলারও নেই। তাই দল হিসেবে খেলে তিন বিভাগে পারফর্ম করেই ম্যাচ জিততে হয় আমাদের। আর এ জায়গাটায় আমরা প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হচ্ছি।
ব্যর্থ হয়েছি নিজেদের সফল টি-টিয়োন্টি বিশ্বকাপটিতেও। যেমন- চলতি বিশ্বকপেই আমরা ব্যাটিংয়ে দল হিসেবে খেলতে পারিনি। যে দুইটা ম্যাচ জিতেছি সেটাও বোলারদের কল্যাণে, অনেক কষ্টেসৃষ্টে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে পাওয়ারপ্লেতে ৪৭ রান তোলার পরেও আমরা মাত্র ১৪৪ রান সংগ্রহ করি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শান্ত ৭১ রানের ইনিংস খেলার পরেও মাত্র ১৫০ রান বোর্ডে জমা করি। আর বরাবরের মতো ফিল্ডিংয়েও ছিল নানা ব্যর্থতা। তাই এখনো অনেক অনেক উন্নতির জায়গা রয়েছে আমাদের।
টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দলটা এখন ট্রানজিশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের একসময়ের তিনজন নিয়মিত সদস্যের মধ্যে দুজন বিশ্বকাপের আগে অবসর নিয়েছেন এবং একজন পারফরম্যান্সের জন্য বাদ পড়েছেন। পার্শ্ববর্তী শ্রীলঙ্কাও সাঙ্গা-মাহেলার অবসরের পর এমন ট্রানজিশনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। এ সময়টায় সবচেয়ে বড়ো নিয়ামক হলো ধৈর্য। সেটা বোর্ড, ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফ, নির্বাচক থেকে শুরু করে সমর্থকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ট্রানজিশন পিরিয়ডে ফল পাওয়ার চেয়েও বেশি জরুরি হলো প্রক্রিয়া মেনে ভবিষ্যতের জন্য দলটাকে ভালোভাবে তৈরি করা। এক্ষেত্রে সময় ও ধৈর্যের সাথে আপসের সুযোগ নেই।
আমি একজন সমর্থক হিসেবে আমাদের সমর্থকদের প্রেক্ষাপটে ধৈর্যচ্যুতির পেছনে কোনো দোষ দেখি না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ট্রানজিশন পিরিয়ডে যাবার আগেও অন্তত একবছর তেমন কোনো সফলতা না পাওয়া। সেজন্য হারতে হারতে ক্লান্ত সমর্থকরা সামান্য ধৈর্য ধরার আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। শ্রীলঙ্কার উদাহরণটা আবারো টানতে হচ্ছে। সাঙ্গা-মাহেলা অবসরে যাওয়ার সময়টায় শ্রীলঙ্কাকে এশিয়া কাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতিয়ে গিয়েছিলেন। তাই ট্রানজিশনে তাঁদের ভক্তদের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণের কাজটা যতটা সহজ ছিল, আমাদের ক্ষেত্রে তা পুরোপুরি ওলটো।
এদিকে দলের টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট বা অলিখিত কোচ শ্রীধরন শ্রীরাম তাঁর বিশ্বকাপ অ্যাসাইনমেন্টে সফল হয়েছেন। সবশেষ এশিয়া কাপ থেকে দায়িত্ব পাওয়ার পর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে রিসোর্সের সর্বোচ্চটা ব্যবহার করে ধীরে ধীরে দলটাকে তিনি শেইপে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন। যদিও আমাদের টি-টোয়েন্টি দলটা এখনো পূর্ণাঙ্গে শেইপে আসেনি। সেজন্য আরো সময় প্রয়োজন। আশা করি, চুক্তি নবায়ন করে শ্রীরামকে সে সময়টা কোনো প্রকার সন্দেহ কিংবা সংকোচ ছাড়াই প্রদান করবে বিসিবি।