এড শিরানের ফটোগ্রাফ গানটিতে আমার খুব পছন্দের একটি লাইন আছে, ‘উই কিপ দিস লাভ ইন এ ফটোগ্রাফ’। একেকটা ছবির মধ্যে থাকে একেকটা গল্প ও একেকটা স্মৃতি। চোখ বুলালে দেখা যায় ছবির মানুষদের, অন্যভাবে ভাবলে তা আবার মনে করিয়ে দেয় ছবিতে না থাকা মানুষদেরও।
ছবি বা ফটোগ্রাফ মজার এক বিষয় বটে। ইন্সটাগ্রামে সম্প্রতি রিকি পন্টিং একটি ছবি শেয়ার করেছেন। এক ফ্রেমে পাশাপশি দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল ম্যাথিউ হেইডেন, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, জাস্টিন ল্যাঙ্গার, রিকি পন্টিং, ড্যারেন লেহমান, গ্রেগ ব্লেওয়েট, শেন ওয়াটসন, অ্যান্ডি বিকেল, ব্রেট লি! আহা শৈশব! আমার শৈশবের রূপকথার সব হিরো একসাথে!
কিন্তু হঠাৎ কেন যেন বুকের বাঁ পাশে শূন্যতার অনুভূতি ছেয়ে গেল! এই ফ্রেমে আরও দুজন মানুষের থাকার কথা। তাঁরা নেই। নেই ফ্রেমে, নেই পৃথিবীতেই! শেন ওয়ার্ন ও অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস আগেও এই ফ্রেমে থাকতে পারতেন। তখন এই ছবিটা পূর্ণতা পেতো।
আমাদের শৈশব- কৈশোর রাঙ্গানোর কাণ্ডারিরা এক ফ্রেমে এভাবেই হাস্যোজ্বল ছবিতে আমাদের দিনটাকেই উজ্জ্বল করে দিতে পারতেন! কিন্তু ওই যে সময়। সময়কে যদি ধরে রাখা যেতো, তবে মানুষগুলোকেও ধরে রাখা যেতো। বুড়িয়ে যেতেন না আমাদের হিরোরা, হারিয়ে যেতেন না পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু বিধির বিধানে শাসন করার ক্ষমতা তো আমাদের দেয়া হয়নি।
এইযে ১১ জন ক্রিকেটার। বলা যায় ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের সবচেয়ে শক্তিশালী সংস্করণের অংশ ছিলেন তাঁরা। অস্ট্রেলিয়া এই অবধি বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছে পাঁচবার। ১৯৮৭, ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭ ও ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হয় তাঁরা। এই যে পন্টিং, গিলক্রিস্ট, হেইডেন, ব্রেট লি সহ ছবিটির অনেকেই মোটামুটি ২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপজয়ী দলের পরিচিত মুখ। অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বে দুবারই বিশ্বকাপের মিশনে নেমেছিল তাঁরা।
২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে প্রতিপক্ষ ভারতকে ১২৫ রানে হারিয়ে তৃতীয় দফায় এবং টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে নিয়েছিল। সেই ম্যাচে অপরাজিত ১৪০ রানের জন্য প্লেয়ার অব দ্য ফাইনাল হন রিকি পন্টিং। বিশ্বকাপে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের শিরোপা ছিল অস্ট্রেলিয়ার জন্য হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়। টানা তিনবার বিশ্ব সেরার সিংহাসনটি দখল করে রাখে তাঁরা।
অস্ট্রেলিয়া সেবার দুর্দান্ত দাপুটে দল ছিলো। ২০০৭ বিশ্বকাপের ম্যাচের পরিসংখ্যান তারই সাক্ষ্য বহন করে। বিশ্বকাপের আসরের ১১ ম্যাচের সবকটি জয় পায় তাঁরা। অস্ট্রেলিয়া আগে ব্যাটিংয়ে নামা মানেই ছিলো অবশ্যম্ভাবি তিনশ প্লাস রানের সমারোহ। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো মাঠে নেমে এতো রান করতে গিয়ে কখনো ছয়টির বেশি উইকেট হারায়নি তাঁরা! ভাবতে পারেন ২০০৭ এর বিশ্বকাপ আসরে অস্ট্রেলিয়া কিরূপ শক্তিশালী দল ছিল! অস্ট্রেলিয়ার প্রতাপ এখানেই শেষ নয়। তিনবার তো তাঁরা প্রতিপক্ষ দলকে দুইশত এর বেশি ব্যবধানে হারিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া দল মানেই সেই সময়তায় ছিল দুর্দান্ত ব্যাটিং ও দুর্দান্ত বোলিং এর কম্বিনেশন।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বৃষ্টি বিঘ্নিত ফাইনাল ম্যাচটি কমিয়ে ৩৮ ওভারের করা হয়। ব্যাটিংয়ে নেমে ১০৪ বলে ১৪৯ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। যার দরুণ অস্ট্রেলিয়া ৩৮ ওভারে ২৮১ রানের বড় টার্গেট দেয় শ্রীলঙ্কাকে। রান তাড়া করতে নেমে সনাথ জয়াসুরিয়া ও কুমার সাঙ্গাকারা ১১৬ রানের জুটিতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি তাঁদের। আরেক দফা বৃষ্টিতে ৩৬ ওভারে ২৬৯ রানের টার্গেট দেয়া হয় শ্রীলঙ্কাকে। যদিও নাটকীয় সেই ম্যাচে শেষমেশ ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে অস্ট্রেলিয়া ফাইনাল জেতে ৫৩ রানে। শেষ হাসিটা হেসে আরেকবার বিশ্বকাপের শিরোপা নিজেদের করে রাখে অস্ট্রেলিয়া।
এই যে কথাগুলো, পরিসংখ্যানগুলো, আর পন্টিং এর শেয়ার করা ছবির মানুষগুলো অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণালী যুগের সাক্ষী। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে উপরোক্ত এগারো ক্রিকেটার ছাড়াও ম্যাকগ্রা, ড্যামিয়েন মার্টিন, বেভান, গিলেস্পিদের নাম উল্লেখ করা অপরিহার্য। ক্রিকেটের ইতিহাসে সেসব কালে অস্ট্রেলিয়া মানেই ছিলো ভয়ংকর এক বিশ্বসেরা দল।