সীমাহীন আকাশের তাজ

একটা সময় অঝোড়ে কেঁদেছিলেন তিনি। জনসম্মুখে, গণমাধ্যমের ক্যামেরাতে। সেবার তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ফিরে আসার। সেই প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছেন তাসকিন আহমেদ। ক্রমশ তিনি নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য উচ্চতায়। বনে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ভরসার প্রতীক।

মাশরাফি বিন মর্তুজার সাথে বুকে বুক মিলিয়ে করা সে উদযাপনের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। ২০১৫ বিশ্বকাপের সে দৃশ্য এখনও রঙিন। এই মাশরাফি হয়ত এখন তাসকিনের এই নব্য জাগরণ খুব বেশি উপভোগ করছেন। তিনিও তো সম্ভাবনার বিশাল এক আলো ছড়িয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে। তবে ইনজুরি তাঁকে করেছে সীমাবদ্ধ। তবে তিনি খুব করে চাইতেন এই তাসকিন হোক আকাশ সমান সীমাহীন।

সেই তাসকিন এখন অদম্য গতিতে ছুটে চলছেন। নিজের ইনজুরিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি ধাবমান ঠিক যেন এক লাগামহীন ঘোড়ার মত করে। প্রতিনিয়ত উপড়ে ফেলছেন প্রতিপক্ষের স্ট্যাম্প। অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল বিদ্যুৎ গতিতে ছুঁয়ে ফেলে প্রতিপক্ষ অধিনায়কের উইকেট। পল স্টার্লিং নিজের ব্যর্থতায় মুচকি হেসে মাঠ ছাড়েন।

ঠিক এতটাই অসহায় বানিয়ে ছাড়েন তিনি প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের। তীক্ষ্ণ লাইন-লেন্থ সাথে আগুন ঝড়া গতি, পাশাপাশি সময় বুঝে করা ভ্যারিয়েশন। এই সবকিছুর মিশেলে সাদা বলে ভয়ংকর হয়ে উঠছেন তিনি। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে, রীতিমত একাই ঘুরিয়েছেন ম্যাচের গতিপথ। এক ওভারে তুলে নিয়েছেন তিনটি মহা গুরুত্বপূর্ণ উইকেট।

প্রথমে লরকান টাকারের উইকেট উপড়ে ফেলেন ইয়োর্কারে। এরপর স্টার্লিংকেও করেন বোল্ড। এরপর তিনি জর্জ ডকরেলকে শামীম পাটোয়ারীর তালুবন্দী করেন। শেষ দিকে মিরাজের হাতে জমা পড়ে হ্যারি টেক্টরের উইকেট। সে উইকেট মালিকও তাসকিন আহমেদ। বৃষ্টি আইনে মাত্র দুই ওভার করতে পারতেন তাসকিন। আর সেই দুই ওভারই যে যথেষ্ট তাসকিনের।

এদিকে বাতাসের একটা গুঞ্জন। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে ডাক আসতে পারে তাসকিন আহমেদের। ডেরা হতে পারে কলকাতা নাইট রাইডার্স। আর ঠিক এই সময়েই টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগারের মালিক বনে গেলেন তিনি। এর আগেও তাসকিনের ডাক এসেছিল আইপিএল থেকে। তবে তিনি দেশকে বেছে নিয়েছিলেন সেবার।

এবারও ব্যতিক্রম হয়ত হবে না। তাসকিন আবারও হয়ত অপেক্ষায় রাখবেন বিশ্বের অন্যতম জাকজমক আয়োজনকে। তবে সেটাতে আখেরে ফায়দাটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের। তিনি দলে থাকা মানেই, দলের বোলিং আক্রমণটা বিশ্বমানের হওয়া। বহুদিনের সেনানী মুস্তাফিজুর রহমানকে পাশে নিয়ে তিনি নেতৃত্ব দেন নবাগত হাসান মাহমুদ, এবাদত হোসেনদের। তিনি ছাড়া বড্ড বেশি এলোমেলো বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ। তাছাড়া তিনি তো অবিচ্ছেদ্য।

তাসকিন সুস্থ আর তাঁকে একাদশে রাখা হবে না, সেটা যেন এক কল্পনা। তিনি নিজের সে জায়গাটা করে নিয়েছেন। তবে তাসকিন যে কেবল নিজের স্বাস্থ্য আর বোলিংয়ের দিকে নজর রাখছেন বিষয়টা তেমন না। তাসকিন নিজের ব্যাটিংটাও শাণ দিচ্ছেন। তিনি জানেন, বিবর্তিত হতে থাকা এই ক্রিকেট দুনিয়ায় একটি মাত্র গুণ দিয়ে টিকে থাকা দায়। তাছাড়া তিনি দলের চাহিদাও বুঝতে শিখেছেন। তিনি জানেন বাংলাদেশের ঘাটতিটা ঠিক কোন জায়গায়।

লম্বা সময় ধরেই বাংলাদেশ একজন কার্য্যকর পেস বোলিং অলরাউন্ডার খুঁজছে। সে জায়গাটা সাইফউদ্দিনের জন্যে বরাদ্দ ছিল বহুদিন। তবে তিনি হতাশ করেছেন। তাইতো তাসকিন নিজেকে সে জায়গাটায় প্রতিষ্ঠিত করতে চান। যেন শেষ দিকেও ব্যাট হাতে ভরসার প্রতীক হতে পারেন তিনি।

এই তাসকিন আহমেদ একদিন নিশ্চয়ই আকাশের মত বিস্তৃতি লাভ করবেন। তিনি হয়ত ছাপিয়ে যাবেন সবকিছু। বনে যাবেন বিশ্ব ক্রিকেটের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। সে স্বপ্ন নিশ্চয়ই তিনি নিজের মধ্যে লালন করেন। আর সেই স্বপ্নের পথে হড়কে যাওয়ার মানুষ এখন আর তাসকিন নন। তিনি মানসিকভাবে আরও বেশি পরিণত, তিনি ক্রিকেটার হিসেবেও উন্নতির পথে। একদিন তিনি বিশ্বব্যাপী নিজের ঝাণ্ডা ওড়াবেন নিশ্চয়ই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link