লর্ড অব দ্য ক্রিজ

কাট শট আর ড্রাইভটা খেলতেন দুর্দান্ত। বলকে পেটাতে পারলেই যেন তিনি শান্তি পেতেন। বোলার কে কিংবা কেমন বল করছেন - সেসবের তোয়াক্কা করতেন না টেড। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলাই ছিল তাঁর কাছে মূখ্য। মারকাটারি ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ করেছিলেন সবাইকে।

ক্যামব্রিজ কলেজের টিম তৈরির কাজ চলছিল। বড় ভাই সেখানে ছোট ভাইর নাম দিয়ে এলেন। বাড়ি ফিরে বললেন – তোমার নাম দিয়ে এসেছি কলেজ টিমে। তোমাকে খেলতে হবে। ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক না থাকা সত্ত্বেও ভাইর কথা চলে গিয়েছিলেন খেলতে।

দুই ভাই ক্যামব্রিজ কলেজেই পড়তেন। ইয়র্কশায়ার, ল্যাঙ্কাশায়ার ও সারে – কাউন্টি ক্রিকেটে তিনটে দলই বেশ শক্তিশালী তখন। তিন দলের বিপক্ষেই চল্লিশোর্ধ্ব ইনিংস খেলে নজরে এলেন অনেকের।

সেখান থেকে ধীরে ধীরে পেশাদার ক্রিকেটে উঠে আসা, ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা জন্মানো। ক্রিকেটকে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন তিনি; সেটা পেরেছেনও বটে। নিজের মত করে খেলে গেছেন পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে। আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে ষাটের দশক মাতিয়ে রেখেছিলেন ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে। বোলারকে কখনোই তিনি মাথায় নিতেন না, আতংক কিংবা ভয় শব্দটা কখনোই গ্রাস করতে পারেনি তাঁকে। ষাটের দশকে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা তারকা ছিলেন এই টেড ডেক্সটার।

একদম অল্প বয়সে ক্যামব্রিজ কলেজের জিম লেকার, ফ্রেড ট্রুম্যানদের বিপক্ষে লড়াই করেছিলেন। পেস কিংবা বাউন্সারে কখনোই তিনি ভয় পাননি – বরং অবলীলায় সেগুলোকে বাউন্ডারি ছাড়া করেছেন। পেশি শক্তিটাও অন্যদের চেয়ে ভাল ছিল। বড় বড় ছক্কাও হাঁকাতে পারতেন অনায়াসে।

মন যা চাইত তাই করতেন তিনি। ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে নিলেও তিনি হতে চেয়েছিলেন একজন গলফার। গলফের প্রতি ঝোঁকটা তার ছেলেবেলা থেকেই। ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়লেও সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন গলফ ক্লাবে। বেশ নামি-দামি তারকা গলফারদের সাথেও খেলেছেন তিনি। ক্রিকেটে অসাধারণ পারফরম্যান্সের ছাপ থাকলেও কখনো সুযোগ আসলে তিনি গলফকেই সবার আগে বেছে নিতেন।

ইতালির মিলান অবশ্য ফুটবলের জন্য বেশ জনপ্রিয়। পুরো ইতালিতেই ফুটবল বেশ বিখ্যাত; গলফের জন্য খুব বেশি জনপ্রিয় সম্ভবত না। ১৯৩৫ সালে এই ইতালির মিলান শহরেই জন্মগ্রহণ করেন টেড ডেক্সটার।

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে। বাবা এডওয়ার্ড র‍্যালফ ডেক্সটার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। অবশ্য এর বাইরেও তার পরিচয় আছে; তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অংশ নেন তিনি।

বিশ্বযুদ্ধের আগেই পুরো পরিবার সমেত এওয়ার্ড ডেক্সটার পাড়ি জমালেন ইংল্যান্ডে। সেসময় টেডের বয়স প্রায় চার বছর। তখনও দুনিয়ার কার্যকলাপ বুঝেই উঠতে পারেননি তিনি। এরপর ইংল্যান্ডেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেন তিনি; দুই ভাইয়ের মধ্যে টেড ছিলেন ছোট। ছোট থেকে গলফ দেখতে এবং খেলতে বড্ড ভালবাসতেন তিনি। এরপর ক্যামব্রিজ কলেজে ভর্তি হন দু’জনে। সেখান থেকেই টেডের ক্রিকেটে উঠে আসা।

১৯৫৮ সালে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয় টেড ডেক্সটারের। অনেকটা মজার ছলেই খেলতে খেলতে ক্রিকেটে ক্যারিয়ার হয় ডেক্সটারের। অভিষেক ইনিংসেই খেলেন পঞ্চাশোর্ধ এক ইনিংস।

কাট শট আর ড্রাইভটা খেলতেন দুর্দান্ত। বলকে পেটাতে পারলেই যেন তিনি শান্তি পেতেন। বোলার কে কিংবা কেমন বল করছেন – সেসবের তোয়াক্কা করতেন না টেড। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলাই ছিল তাঁর কাছে মূখ্য। মারকাটারি ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ করেছিলেন সবাইকে।

১৯৬৩ সালের লর্ডস টেস্টের কথাই ভাবুন। সেবার শক্তিশালী ক্যারিবিয়ানরা এসেছিল ইংল্যান্ড সফরে। চার্লি গ্রিফিথ, ফ্র‍্যাঙ্ক ওরেল, ওয়েস হলদের নিয়ে গড়া বিধ্বংসী বোলিং লাইন আপের সামনে ইংলিশদের মুখ থুবড়ে পড়াটাই ছিল স্বাভাবিক। প্রথম টেস্টেই সেটা প্রমাণ হয়ে যায়। ওল্ড ট্রাফোর্ডে দশ উইকেটের হারে ক্যারিবিয়ানদের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করে ইংলিশরা।

দ্বিতীয় টেস্টে লর্ডসেও প্রথম ইনিংসে ৩০১ রানের সংগ্রহ পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ১ রানে প্রথম ও ২০ রানে ২ উইকেট হারিয়ে আবার বিপর্যয়ে পড়ে ইংলিশরা; ব্যাট হাতে নামলেন ডেক্সটার। ঘন্টাখানেকের বেশি সময়টা পুরো লর্ডস তাকিয়ে ছিল ডেক্সটারের ব্যাটের দিকেই।

দর্শকভর্তি লর্ডসে ক্যারিবিয়ান পেসারদের তুলোধুনো করে ৭৫ বলে ৭০ রানের তাণ্ডব এক ইনিংস খেলেন ডেক্সটার। দলীয় ১০২ রানের মধ্যে ৭০ রানই করেন তিনি। গ্রিফিথ, ওরেলদের সামনে যেখানে ওপেনাররা দাঁড়াতে পারেনি সেখানে নতুন বলেই তাণ্ডব চালান ডেক্সটার। মারকাটারি ব্যাটিংয়ে সেদিন লর্ডস মাতিয়ে রেখেছিলেন ডেক্সটার।

সেবার অ্যাশেজ সিরিজেও দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন তিনি। ৪৮.১০ গড়ে করেছিলেন ৪৮১ রান। ওই সিরিজে অধিনায়ক ছিলেন টেড। ১৯৬১ সালে উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারদের একজন নির্বাচিত হয়েছিলেন টেড। ওই মৌসুমে তিনি ছিলেন উড়ন্ত ফর্মে। ১০ ম্যাচে দুই সেঞ্চুরি ও পাঁচ ফিফটি করেন টেড।

টেডকে নিয়ে উইজডেন লিখেছিল, ‘গেল সামারে ওভালে সারের বিপক্ষে সাসেক্সের হয়ে ব্যাট করছিলেন টেড। প্যাভিলিয়ন প্রান্ত থেকে বোলার ছুঁটে আসছেন। ফুট ম্যুভমেন্ট স্বাভাবিক, হেড পজিশনও একই রইলো। কিন্তু ব্যাট এতো জোরে স্যুইং করলো যে লং অনের উপর দিয়ে বিশাল বড় এক ছক্কা। খানিকটা সময় খোঁজাখুজির পর গ্যালারির সিটের নিচ থেকে বলের হদিস পাওয়া গিয়েছিল।’

৬২ টেস্টে ৪৮ গড়ে ৪৫০২ রান। ৯ সেঞ্চুরি আর ২৭ ফিফটি। ষাটের দশক বিবেচনায় নিঃসন্দেহে অসাধারণ পরিসংখ্যান। বেশ কিছু সময় ইংল্যান্ডের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ৩০ ম্যাচে তাঁর অধীনে ইংলিশরা জয় পেয়েছিল ৯ টেস্টে, বিপরীতে হেরেছে সাত ম্যাচে।

ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে বিদায় জানানোর পর ডেক্সটার সাংবাদিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন! বেশ শৌখিন এক ক্রিকেটার ছিলেন টেড। পছন্দসই জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন, পিআর ফার্মে সময় দিতেন। আবার সুযোগ হলেই খেলতেন গলফ। ক্রিকেটকে বিদায় জানালেও গলফকে জীবনে থেকে ছাড়েননি এই তারকা। ব্যক্তিগত বিমানও চালানে মাঝেসাঝেই।

ষাটের দশকে তিনি সবচেয়ে সেরা তারকাদের একজন। জীবনকে উপভোগ করার প্রকৃত উদাহরণ বোধহয় টেড ডেক্সটার। কোনো কিছুতেই বিচলিত কিংবা চিন্তিত হননি তিনি। যখন যা মন চাইত তাই করেছেন, কোনো কিছুর পরোয়া করেননি। ২০২১ সালে ৮৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ডেক্সটার না থাকলেও, থেকে গেছে তাঁর কীর্তি। ক্রিকেট ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবেই থেকে যাবেন তিনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...