Social Media

Light
Dark

শিল্পীর বিদায়, শিল্পের নয়

সাল ১৯৮৩ ৷ ক্লাস ফোরে উঠেই নতুন বই পাওয়ার পর বাংলা বইতে পেলের জীবনী পড়ার মাধ্যমেই পেলে ও ব্রাজিল ফুটবল সম্পর্কে জানতে পারলাম ৷ তখনও আমাদের এলাকাতে কারেন্ট ছিল না ৷ টেলিভিশন তো দূরের কথা ৷ কেবল একটা প্রবন্ধ পড়েই তার জীবনের ম্যাজিক ও ব্রাজিল ফুটবল ম্যাজিক পড়েই একটা কিশোরের বুকে ব্রাজিল দল চিরস্থায়ী ছাপ নেয় কোন একটা ম্যাচ না দেখেই ৷ তিন বছর বাদে, কারেন্ট আসা, টিভিতে সরাসরি ম্যারাডোনা ম্যাজিক দেখার পরও সেই ছাপ মোছেনি ৷

সাও পাওলোর দারিদ্রপীড়িত বস্তিতে তাঁর জন্ম। সেখানকার রাস্তায় মোজা মুড়িয়ে বল বানিয়ে কিংবা জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতেন। ঠিক খেলতেন নয়, খেলার পাশাপাশি জাদুকরি সব মুহূর্তের জন্ম দিতেন ওই অল্প বয়সেই। পরিবারের একটা ফুটবল কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও ছিল না।

কিন্তু ১৫ বছর বয়সে সেই ছেলেটিই সান্তোসের মূল দলে গোলের পর গোলের মালা গেঁথেছেন। ১৬ বছর বয়সে খেলেছেন ব্রাজিল জাতীয় দলে। জীবনের প্রথম ম্যাচেই আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোল করেছেন ৷ আর ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ৪ ম্যাচে ৬ গোল করে ব্রাজিলকে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। হয়ে গেলেন সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপজয়ী!

কিন্তু সেটা কেবলই পেলের শুরু। ৬২ তে মাত্র দুটো ম্যাচ খেলতেই তিনি প্রতিপক্ষের কড়া ফাইলের শিকার হয়ে রইলেন ৷ গারিঞ্চা জাদুতে সেবার ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতে নেয় ৷ ১৯৬৬ তে তাকে সহ পুরো ব্রাজিল দলকে এমন নির্মমতায় ফাউল করে আহত করা হয়েছিল যে লিগের শেষ ম্যাচে একটা সুস্থ একাদশ নামানোই দুষ্কর ছিল ব্রাজিলের জন্য ৷ কিন্তু ১৯৭০ এ সালে তাকে ও ব্রাজিলকে থামানো সম্ভব হয়নি । বিশ্বের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনি তিনটি বিশ্বকাপ জিতে নেন ৷

সর্বকালের সেরা হবার জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল কিন্তু তাতেই তিনি বিশ্বসেরা নন ৷ বহু বছর ধরেই ব্রাজিল যে আন্তর্জাতিক মানসন্মত ফুটবলারের যোগানদাতা, তার পেছনে ছিলেন এই কালোমানিক ৷ খেঁটে খাওয়া বস্তির কিশোরের দল যখন ভয়াবহ মাদকে আসক্ত, তখন তার কৃতিত্বেই ঐ সব বস্তি থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসতে থাকে সক্রেটিস, টোস্টাও, জোয়ারজিনহো (৭০ বিশ্বকাপে লিগের প্রতিটি ম্যাচ সহ ফাইনাল পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচেই গোল করা এখন পর্যন্ত একমাত্র ফুটবলার) সহ অসংখ্য তারকা ফুটবলারের আদর্শ ছিলেন তিনি৷

তিনি কেন কোনদিন ইউরোপ খেলেননি, সেটা নিয়ে বহু জন প্রশ্ন তুলেছেন ৷ তার গ্রেটনেস নিয়ে সন্দেহ করেন ৷ আচ্ছা, এই যে, মেসি জীবনের প্রায় সবটুকু সময়ই বার্সায় কাটালেন, এতে কি তার গ্রেটনেস কমে গেছে? আসলে পেলে কখনও ইউরোপিয়ান ফুটবল পছন্দ করতেন না ৷ তিনি ও সান্তোস, একে অন্যের জন্যই ছিলেন ৷ তার আমলেই সান্তোস প্রথম লাতিন সেরা ক্লাব হয় এবং পরে রেকর্ড পরিমাণ শিরোপা (প্রায় ৪০ টা মেজর শিরোপা) জেতেন ক্লাবের হয়ে ৷

১৩৬৬ ম্যাচে ১২৮২ গোলের এই যে রেকর্ড, তা কেবল লাতিন ক্লাব বলে উপেক্ষিত হবার নয় ৷ তার সময়ে ইউরোপ থেকে লাতিন ফুটবল অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা-পূর্ণ ছিল এবং তার এই গোলের রেকর্ড কোনভাবেই ভাঙ্গার সম্ভাবনা দেখি না ৷ এটা ব্রাডম্যানীয় গড় এর মতই অমরত্ব লাভ করেছে ৷

আমাদের ফুটবল বিতর্ক জীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে পেলে না ম্যারাডোনা বড় ৷ দুইজন দুই সময়ের ফুটবলার হওয়া, দুজনের ক্যারিয়ার দুই গতির হওয়া, দুজনের এচিভমেন্টে ভিন্নতা হওয়া স্বত্বেও পুরো একটা যুগ কেটে গেছে এদের নিয়ে বিতর্কে ৷ ফিফা গত শতাব্দীর সেরা ফুটবলার বাছাইয়েও ব্যর্থ হয়েছে ৷ একজন দর্শকের জরিপে, অন্যজন ফিফা টেকনিক্যাল কমিটির বিচারে সেরা ৷

আজ সে সব বিতর্ক থামিয়ে পেলে চলে গেলেন ম্যারাডোনার কাছে যিনি ২ বছর আগেই সেই পরলোকে গিয়ে পেলের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন ৷ এখন সেখানে যদি ফুটবলের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষের খচখচানি বাঁচিয়ে ফুটবল নামক মহান শিল্পের চর্চা করবেন কোন বিতর্ক ছাড়াই ৷

যুগে যুগে শিল্পি আসে, শিল্পচর্চা হয়, ফুটবল নামক চর্মগোলকের মোহে পড়ে আমরা মানুষেরা বিমোহিত হয়, বিতর্ক করি, তারই মাঝে সেই সব শিল্পিরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, রয়ে যায় তাদের অমর শিল্প ৷

পেলে, আপনি চলে গেলেন ৷ কিন্তু রেখে গিয়েছেন এমন কিছু শিল্প যা ভবিষ্যতের মানুষদের কাছে আপনাকে অমর করে রাখবে ততদিন যতদিন এ গ্রহে ফুটবল খেলা চলবে ৷ বিদায় ফুটবল রাজা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link