টেস্ট ক্রিকেটে দশ উইকেট পাওয়া যেকোন বোলারের জন্যই স্বপ্ন। তবে সেই স্বপ্নই যেন দু:স্বপ্ন হয়ে এসেছিল প্রজ্ঞান ওঝার জীবনে। একমাত্র দশ উইকেট পাওয়া ম্যাচটাই যে তাঁর আন্তুর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছিল। ঠিক যেই ম্যাচটাতে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়ে শচীন টেন্ডুলকারকে টেস্ট ক্রিকেটে বিদায় জানিয়েছিলেন তখন কী প্রজ্ঞান ওঝা বুঝতে পারছিলেন বেজে গিয়েছে তাঁরও বিদায় ঘণ্টা।
১৯৮৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের ঐতিহাসিক শহর ভুবনেশ্বরে জন্মগ্রহণ করেন প্রজ্ঞান ওঝা। সাত’শ মন্দিরের শহরে বল হাতে ছোটাছুটি করতেন ১০ বছর বয়সী ওঝা। শহরের এক স্পোর্টিং ক্লাবে শুরু হয় তাঁর ক্রিকেট যাত্রা। ক্রিকেটের সহজাত প্রতিভা নিয়ে জন্ম নেওয়া ওঝা এগিয়ে যাচ্ছিলেন দ্রুতই। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই হায়দ্রাবাদের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন।
২০০৬-০৭ মৌসুমের রঞ্জি ট্রফিতে মাত্র ৬ টি ম্যাচ খেলেই নিয়েছিলেন ২৯ উইকেট। ওই আসরে তাঁর বোলিং গড় ছিল মাত্র ১৯.৭৫। এছাড়া ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়েও তখন ডাক পান এই স্পিনার। তবে ২০০৭ সালে রঞ্জি ট্রফিতে তাঁর পারফর্মেন্স ভারতীয় নির্বাচকদের নজর কেড়েছিল। তখন থেকেই ভারত দলের জন্য নজরে ছিলেন এই স্পিনার।
সুযোগও আসে পরের বছর এশিয়া কাপে। ২০০৮ সালে এশিয়া কাপ দলে ডাক পান তিনি। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজের অভিষেক ম্যাচেই নিয়েছিলেন ২ উইকেট। সেই বছরই হয় টি-টোয়েন্টি অভিষেকও। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচেই মাত্র ২১ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। সেই ম্যাচের ম্যান অব দ্যা সিরিজও হয়েছিলেন এই স্পিনার।
তবে ওঝার সেরাটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁর টেস্ট অভিষেকের। ২০০৯ সালে কানপুরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অবশেষে অভিষিক্ত হন টেস্ট ক্রিকেটে। অভিষেক সিরিজের দুই ম্যাচে নিয়েছিলেন মোট ৯ টি উইকেট। সেই সময় টেস্টে হরভজন সিং এর বোলিং পার্টনার হিসেবে তাকেই ভাবতে শুরু করেছে ভারত।
২০১০ সালে ৯ ম্যাচ খেলে নিয়েছিলেন ৩৩ টেস্ট উইকেট। পরের বছর মাত্র ৩ টেস্ট খেলেই তুলে নিয়েছিলেন ২০ উইকেট। সেই সময় হরভজন ও ওঝার স্পিন জুটি বেশ ভয়ানক হয়ে উঠেছে প্রতিপক্ষের জন্য। হরভজনের বিদায় পর ওঝা জুটি গড়েন আরেক স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সাথে। ২০১২ সালে ৬ টেস্টে খেলেই ২৫.৯৬ গড়ে নেন ৩৩ উইকেট। ওই বছর ৩ বার পাঁচ উইকেটও নেন এই স্পিনার।
ওদিকে ভারতের হয়ে ১৮ টি ওয়ানডে ও ছয় টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচও খেলেছিলেন এই স্পিনার। ওয়ানডে ক্রিকেটে ৩১ গড়ে আছে ২১ টি উইকেট। ওদিকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও আছে ১০ উইকেট। টি-টোয়েন্টিতে তাঁর বোলিং গড় ছিল মাত্র ১৩.২০। ব্যাটসম্যানদের এই ফরম্যাটে ওঝার ইকোনমি রেট ছিল মাত্র ৬.২৮।
২০১৩ সালে মুম্বাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বিখ্যাত সেই টেস্ট। ক্রিকেটের কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের শেষ ম্যাচ। সেই ম্যাচে ৪৯৫ রানের বিশাল সংগ্রহ করেছিল ভারত। মুম্বাইয়ে ব্যাটিং পিচেও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৮২ ও ১৮৭ রানে অল আউট করে দিয়েছিল ভারত। আসলে কাজটা করেছিলেন প্রজ্ঞান ওঝা।
প্রথম ইনিংসে মাত্র ১১.২ ওভার বোলিং করেই নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। আরেক স্পিনার অশ্বিন নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। পরের ইনিংসেও একই রকম অপ্রতিরোধ্য ওঁঝা। এবার ১৮ ওভার বল করে ৪৯ রান দিয়ে আবারও নিলেন ৫ উইকেট। তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত ১০ উইকেট নিলেন এই স্পিনার। ওই ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচও হয়েছিলেন তিনি।
তবে সেই টেস্টের পর আর কখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয়নি এই স্পিনার এর। পরের সিরিজে তাঁকে ছাড়াই ঘোষণা করা হয় দল। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে লড়াই চালিয়ে যান তিনি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বোলিং অ্যাকশনের কারণে নিষিদ্ধ হন। ২০১৫ সালে অ্যাকশনের পরীক্ষা দিয়ে আবার ফিরে আসেন ক্রিকেট মাঠে। তবে এরপর আর কখনো ভারত দলে ফিরতে পারেননি। কেননা অশ্বিনের সাথে তখন বোলিং জুটি গড়েছেন আরেক স্পিনার রবীন্দ্র জাদেজা।
২০১৫-১৬ মৌসুমে সৌরভ গাঙ্গুলির অনুরোধে ক্রিকেট খেলেন বেঙ্গলের হয়ে। দুই মৌসুম বেঙ্গলের হয়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছিলেন এই স্পিনার। তবে তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার থেমে যায় ২০১৩ সালে মাত্র ২৪ টেস্টেই। ২৪ টেস্টে এই স্পিনারের ঝুলিতে ছিল ১১৩ টি উইকেট।
তবুও কী এক অজানা কারণে আর কখনো ফেরা হয়নি ওঝার। আরেকটাবার সুযোগ হয়তো পেতেই পারতেন প্রজ্ঞান ওঝা। তাঁর গলায় অভিমানের সুর হয়তো এখনো বাজে, তবে সেই সুর কী ভারতের ক্রিকেট উল্লাসে শোনা যায়?