ঊনপঞ্চাশের অভিশাপ

আমার কাজ কী? বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিকে ম্যানুফ্যাকচারিং এক্সিউকিউশন সলিউশন সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়া, তাদের প্ল্যান্ট-আউটপুট বাড়ানো, আনপ্ল্যানড ডাউনটাইম কমানো, কর্পোরেট প্ল্যানের সঙ্গে প্ল্যান্ট এক্সিকিউশনের আরও সিনক্রোনাইজেশন তৈরি করা, মার্কেটের চাহিদা বুঝে আরও স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যানিং করতে সাহায্য করা – ইত্যাদি, প্রভৃতিতে কাস্টমারকে হেল্প করাই আমার মূল কাজ।

আরও সাধারণীকরণ করে বলতে গেলে, আমার কাজ ব্যবসায়িক সমস্যার টেকনোলজি-সলিউশন খুঁজে বের করা। কুড়ি বছর ধরে এই করেই পেট চলছে। ইনফোসিস, আইবিএম ঘুরে এখন কগনিজেন্টে— তাহলে ধরে নেওয়া যায়, অসাধারণ কিছু না হলেও, একেবারে ফেলে দেওয়ার মতোও নয় এই বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা, স্কিলসেট এবং দূরদৃষ্টি/অন্তর্দৃষ্টি।

সমস্যা হল, আমি ফেসবুকে এ নিয়ে কিছুই বলি না। বলি ক্রিকেট নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, সিনেমা নিয়ে। বলি এমন সমস্ত বিষয় নিয়ে, যে বিষয়ে আমার স্কিলসেট প্রায় নেই, অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার শূন্য এবং আমার দক্ষতাকে কোনো লাভজনক সংস্থা পয়সা খরচ করে কাজে লাগাতে চাইবে না।

ফলে কী দাঁড়ায়?

ফলে দাঁড়ায় এই যে, দুপুরের ইডেনের তখনো-না-ভাঙা পিচ, নতুন কোকাবুরা বলের ইজি পেস, রোহিত শর্মা নামক প্রতিভাবান দৈত্যের স্ট্রোক-মেকিংয়ের অকল্পনীয় ক্ষমতা— এসব কিছুই না বিচার করে, স্কোরবোর্ডে ২০ বলে ৪০ করেছে দেখেই লাফিয়ে উঠি, ‘এই তো, এ তো সহজ ঐকিক নিয়ম। কুড়ি বলে চল্লিশ হলে, তিনশো বলে ছ’শো। সঙ্গে এক্সট্রা আরও খান-বিশেক। দাঁড়াল গিয়ে ছ’শো কুড়ি। নাও, ডিসকাউন্ট দিলাম ৩৫% মতো। রাফলি দাঁড়াল গিয়ে ৪০০ – আরে বাবা, অন্তত এইটুকু রান তো করবে?’

এদিকে হয়েছে কি, আপনি ঐকিক-নিয়ম জানেন না। শতকরার হিসেবও মনে নেই। কিন্তু আপনি জানেন, আমি খুবই জানকার আদমি। বড় জায়গায় চাকরি করি (সুতরাং আমি সব জানি) মানেই জীবনে সফল। আর কে না জানে, জীবনে সফলরাই একমাত্র জ্ঞানী (উল্টোটা নয় একদমই)। আপনি ইত্যাকার কারণে বিশ্বাস করে নিলেন, আমি যা-যা বলেছি সব সত্য, সব সুচিন্তিত এবং গবেষণালব্ধ— এবং আপনি আমার পোস্টটি শেয়ার করে ফেললেন ঝপ করে।

সেই আমোদগেঁড়ে মার্কা জ্ঞান, সেই আধকাঁচা টেকনিক্যাল কচকচি, সেই অনভিজ্ঞতাজনিত হাম্বড়ামি ‘শ্বাশ্বত সত্য’ হয়ে চারিয়ে পড়ল সমাজমাধ্যমে।

যদি ধরেও নিই, আপনি বেশ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, আমার পোস্টটিকে মজার বলেই গ্রহণ করেছেন এবং বন্ধুমহলে মজা নেওয়ার জন্যই ছড়িয়েছেন— আমাদের দেশের নাগরিকদের গড় সচেতনতা ও শিক্ষার প্রসার দেখে আন্দাজ করতে পারি, আপনার থেকে যাঁরা এই শেয়ারিত ‘গবেষণা’টি পেলেন তাঁদের একটি বড়সড় শতাংশ এটিকে কিন্তু “তথ্য” বলে মেনে নিলেন, বিনা প্রশ্নে, বিনা তর্কে।

এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। দুর্ভাগ্যজনক আমার পক্ষে নয়, ২৭৭ ইনিংসে অবিশ্বাস্য ৪৯টা সেঞ্চুরি করা বিরাট কোহলির পক্ষে। মনে রাখবেন, একদিনের ক্রিকেটের ৫২ বছরের আয়ুষ্কালে তিনি মাত্র দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান যিনি এতগুলি শতরান করেছেন। মনে রাখবেন, তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, যাঁকে অধিকাংশ ভারতীয় ক্রিকেটদর্শক বিনা বাক্যব্যয়ে ক্রিকেটের ভগবান বলে মেনে নিয়েছেন, সেই সচিন তেণ্ডুলকরের একইসংখ্যক শতরান করতে সময় লেগেছিল ১৭৫ ইনিংস বেশি।

১৭৫ ইনিংস! তফাৎটা মহাজাগতিক বললে কিছুই বোঝানো হয় না। স্যর ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস গোটা কেরিয়ারে এর চেয়ে মাত্র ৭টি ইনিংস বেশি খেলেছেন। অর্থাৎ বিরাট কোহলি ৪৯টি সেঞ্চুরি করতে যতগুলি কম ইনিংস খেলেছেন তা একজন ক্রিকেটারের গোটা কেরিয়ারের ইনিংসের সংখ্যা হতেই পারে; যা-তা কেরিয়ার নয়, বেশ ভাল কেরিয়ার হলেও।

এইরকম একটা মাইলস্টোনে যিনি পৌঁছচ্ছেন, তাঁর ক্রিকেট বুদ্ধি, পিচ বিচার করার ক্ষমতা, ‘পার-স্কোর’ আন্দাজ করার ক্ষমতা আমার-আপনার চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশিই হওয়া স্বাভাবিক, তাই না? বিশেষ করে তিনি যখন উল্টোদিকে প্রতিভাবান শুভমন গিলকে স্পিন-পেস-ট্র্যাজেক্টরিতে পরাস্ত হয়ে বোল্ড হতে দেখছেন, যখন দেখছেন তাঁর নিজের এবং নতুন করে জেগে ওঠা শ্রেয়স আইয়ারের (ইনি স্পিনটা মন্দ খেলেন না, এমনটাই অরণ্য-প্রবাদ) বারবার লিডিং-এজ হচ্ছে – ভারতীয় ব্যাটারদের স্পিনের বিরুদ্ধে প্রধান স্কোরিং শট – ওই স্কোয়ারলেগে খুচরো প্লেসমেন্ট ছেঁটে ফেলতে হচ্ছে কিতাব থেকে; যখন তিনি দেখছেন পেস কমিয়ে কাটার দিয়ে রাবাদা ফলস শট মারিয়ে নিচ্ছেন ঘাড় ধরে – তখন ঠিক কোন পর্যবেক্ষণ, কোন যুক্তি আপনাকে বলে, আপনাকে বোঝায় যে এই পিচটি ৪০০+ রানের? ঠিক কোন তথ্যের ভিত্তিতে আপনি ধরে নেন যে বিরাট কোহলি সেঞ্চুরির জন্য ‘ইচ্ছাকৃত’ স্লো খেলেছেন?

তিন-ঘন্টার বেশি ব্যাট করে আসা ব্যাটার বলছেন পিচটা ৩০০+-এরও নয়। তাঁর দলের বোলারদের বোলিং এবং এই টুর্নামেন্টের অন্যতম ভীতিপ্রদ ব্যাটিং লাইন-আপের হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়া সেটা প্রমাণও করে দিচ্ছে পরে। অথচ ধন্য আমার প্রজ্ঞা, ধন্য আমার ‘অকারণ আহাম্মকি’ – যে আমি ভেবে যাচ্ছি, ‘না! ওরা ভুল বলছে। ক্রিকেটটা মাঠে নেমে নয়, খাতায়-কলমে পাটিগণিত কষেই খেলা যায়!’

ধরে নিচ্ছেন, কারণ ‘আমি’ এমনটা বলছি। কারণ আপনি মনে করছেন, আমি যেহেতু ‘বড় পণ্ডিত’, সেহেতু মাঠে না নামলেও খেলাটা আমি বিরাট কোহলি/রোহিত শর্মার চেয়েও ভাল বুঝি। আমার-আপনার করা অভিযোগগুলির মধ্যে কী আত্মবিশ্বাস; প্রশ্ন নয়, জানার কৌতূহল নয়, সরাসরি উদ্ধত সিদ্ধান্ত চলকে পড়ছে। ভাবখানা এমন, ও যে, যত যা-ই বলুক, আমার মতো উর্বর মস্তিষ্ক, আমার মতো বিশ্লেষণী জ্ঞান এদের কারো নেই, ধুস!

ভাগ্যিস বিরাট কোহলি ফেসবুকের পোস্ট পড়ে ব্যাট করতে যান না। ভাগ্যিস রোহিত শর্মা ক্রিকেট গ্রুপের থেকে নিজের আইডিয়া নেন না। ভাগ্যিস রাহুল দ্রাবিড় ‘আমাকে’ বিরাট পণ্ডিত মনে করেন না।

বিরাট, আপনাকে আভূমি প্রণাম জানাই, এই অপোগণ্ডদের দেশে আপনি নিজের পেশায় এমন চরম নৈপুণ্যের সাক্ষ্য রাখতে পারলেন বলে। প্রার্থনা করি, খুব শিগগিরই পঞ্চাশতম সেঞ্চুরিটিও করে ফেলুন, বিশ্বকাপের নকআউটেই।

আসলে, ঊনপঞ্চাশ নম্বরটা তো খুব একটা সৌভাগ্যজনক নয়। রিটায়ার করার দশ বছর পরে হয়তো দেখবেন, আমরা (না, না, আমি) আবিষ্কার করছি, এক্সেলশিটে বা অঙ্কের খাতায় ক্রিকেটটা আপনি মোটেও ভাল খেলেননি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link