বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ‘আপসেট’টা হয়েছে তখনও ২৪ ঘণ্টাও হয়নি। আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়েছে পাকিস্তান। সেই আয়ারল্যান্ড যারা সেবার প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলতে আসে।
এমন সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো বটেই গোটা ক্রিকেট বিশ্বের মাটি কেঁপে ওঠে মাঠের বাইরের এক ঘটনায়। হোটেল রুমে অবচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় কোচ বব উলমারকে। প্রোটিয়া এই কোচ ছিলেন পাকিস্তান দলের দায়িত্বে। কিংবদন্তি এই কোচকে নতুন করে চেনানোর কিছু নেই। ক্রিকেটের আজকের দিনেরে কোচিংয়ের যে আধুনিকায়ন – তাঁর অধিকাংশের শুরুই এই উলমারের হাত ধরে। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। দিনটা ছিল ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ। এর তিন দিনের মধ্যেই গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে মাঠে নামার কথা পাকিস্তানের।
বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৮ বছর। এরপরই শুরু হয় বিতর্ক। উলমারের মৃত্যু কি স্বাভাবিক ছিল ? নাকি এর মধ্যে অন্য কিছুর হাত আছে? বাজিকররা জড়িত না তো? পাকিস্তান দলের কেউ সেই বাজিকরদের সাথে সম্পৃক্ত না তো? – পাকিস্তান দলের কোচ ছিলেন বলেই কি না দক্ষিণ আফ্রিকান এই কোচের অস্বাভাবিক এই মৃত্যু নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে। যদিও, প্রাথমিক রিপোর্টে দেখা যায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মানে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান উলমার।
চারদিনের মধ্যে জ্যামাইকার পুলিশ মৃত্যু তদন্তে মাঠে নেমে যায়। কারণ, তাঁরা উলমারের চিবুকে নখের আঁচড় খুঁজে পান। এখানেই শেষ নয়, মারা যাওয়ার আগের রাতে দু’জন অপরিচিত ব্যক্তি উলমারের সাথে দেখা করতে আসেন। আর তাঁর ঘরে এমন একটা মদের বোতল পাওয়া যান, যেটা তিনি খান না।
ফলে, প্রশ্ন ছিল একটাই তাঁদের সামনে – এটা কি স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি খুন? সেটা ছিল ২২ মার্চ। ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মার্ক শিল্ডস ঘটনাটা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। মার্ক শিল্প স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের খ্যাতনামা গোয়েন্দা। সিসিলি, রাশিয়াতে তাঁর বেশ সফলতা আছে।
পাকিস্তান দলের সবাইকে জেরা করা হয়। হোটেলের দায়িত্ব প্রাপ্তদের সাথেও কথা বলা শুরু হয়। আস্তে আস্তে ঘটনার জট খুলতে শুরু হয়।
গণমাধ্যমও থেমে ছিল না। খবর আসে, ভেষজ বিষ প্রয়োগে মারা হয়েছে উলমারকে। কেউ কেউ এটাও লিখেছিল, খুনিকে পাওয়ার দুয়ারে চলে এসেছেন মার্ক শিল্ড।
যদিও, ২০০৭ সালের ১২ জুন ভুতুড়ে এক বিজ্ঞপ্তি দেয় জ্যামাইকা কন্সটাবুলারি ফোর্স। সেখানে কমিশনার লুসিয়াস থমাস দাবি করেন, বব উলমার স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা কোনো অবকাশ নেই বলেও দাবি করেন তিনি। বিবৃতিতে বলা হয়, বেশ কয়েকদিন ধরেই স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন উলমার, এর মধ্যে ডায়বেটিস ও হার্ট বড় হওয়াও ছিল।
অবাক করা ব্যাপার হল, এতদিন যে তদন্তের সব বিষয়ে কথা বলছিলেন ডেপুটি কমিশনার মার্ক শিল্ড, এবার সেখানে তাঁর কোনো মন্তব্য নেই। এমন কি বিবৃতিতে কোনো স্বাক্ষরও দেননি। এমন কি এর পরে সেই তদন্ত নিয়ে কখনোই তিনি কোনো কথা বলেননি।
যে মৃত্যু তদন্ত আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছিল, সেটা হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়ার কারণই বা কি! বিষয়টা আজও এক রহস্য। কাকতালীয় ব্যাপার হল, এই উলমারই ছিলেন হ্যান্সি ক্রনিয়ের কোচ। আর হ্যান্সি ক্রনিয়ে যখন ফিক্সিংয়ে জড়ান – তখনও কোচ ছিলেন উলমারই। এই জুটি মিলে মাঠে এয়ারফোন ব্যবহার-সহ অনেক আধুনিকায়নই আনেন। বলা হয়, হ্যান্সির জীবনে এমন কোনো অধ্যায় নেই – যা উলমার জানেন না। ফলে, তাঁর মৃত্যর পিছনে হ্যান্সির ফিক্সিং কেলেঙ্কারি কিংবা বাজিকরদের প্রভাবকে একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তদন্ত থামিয়ে দেওয়ার বেশ পরে, ফক্স স্পোর্টসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান গ্রেট ক্লাইভ রাইস বলেছিলেন, ‘এই মাফিয়া বেটিং সিন্ডিকেটকে কোনো কিছুই থামাতে পারে না, ওদের পথে যারাই আছে ওরা কোনো পরোয়া করে না!’ উলমারের মৃত্যুর ব্যাপারে তাঁর ইঙ্গিতটা কোথায় সেটা বোধকরি আর না বলে দিলেও চলে।
সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেলও প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘ওর মৃত্যু আদৌ স্বাভাবিক কি না – সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। হয়তো পুলিশ যা তথ্য দিচ্ছে – তার অনেক কিছু সত্য নাও হতে পারে।’
ওই বিশ্বকাপ শেষেই কোচিং ক্যারিয়ারের ইতি টানতে চেয়েছিলেন উলমার। জানা গিয়েছিল, তিনি আত্মজীবনীর কাজ করছিলেন। কোচিং ক্যারিয়ার শেষে সেটা প্রকাশ করা হবে। আত্মজীবনী লেখার কাজও নাকি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, মৃত্যুর পর ল্যাপটপ ঘেঁটে কোনো আত্মজীবনীর অংশ বিশেষও পাওয়া যায়নি!
তাহলে কি সত্যিই কেউ নিজেদের পথের কাঁটাকে আসলেই চিরতরে সরিয়ে দিয়েছেন। ক্লাইভ রাইস তো বলেই দিয়েছেন, ‘ওরা কোনো কিছুর পরোয়া করে না!’