৬ এপ্রিল ২০১৪; মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল। ইংল্যান্ডের দেয়া ১০৬ রানের টার্গেট তাড়া করছে অস্ট্রেলিয়া। ইনিংসের ১৬ তম ওভারের প্রথম বল। মিড উইকেট বাউন্ডারিতে বল ঠেলে দিলেন এলিস পেরি। ব্যাস চলে আসলো হ্যাটট্রিক শিরোপা। বিজয়ের উল্লাস তখন অস্ট্রেলিয়া দলে।
একটু উনিশ-বিশ হলে সেই বছরের মে মাসে ব্রাজিলে দুটি ম্যাচ খেলার কথা ছিল এই খেলোয়াড়ের। নিশ্চয়ই ভাবছেন ব্রাজিলে আবার কিসের ক্রিকেট! না, ক্রিকেট নয় সেই ম্যাচ দুটি আসলে ফুটবল। ক্রিকেট আর ফুটবল এক সাথে খেলাটা তার জন্য নতুন কিছু নয়।
সেই ষোল বছর বয়স থেকেই তিনি দুটিতেই নিয়মিত খেলে আসছেন জাতীয় দলের হয়ে। নারী অথবা পুরুষ – দুটি দলেই খেলে ফেলা সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হলেন এই এলিস পেরি। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই যে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়ে গেছে দুটিতেই!
এক হিসেবে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন বিশ্বের আর সকল নারীকে। তিনি ইতিহাসের প্রথম নারী যিনি ক্রিকেট ও ফুটবল দুটিতেই দেশের হয়ে খেলেছেন বিশ্বকাপের আসরে। এখানেই শেষ নয়, অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় একটা টিভি ও রেডিও চ্যানেলে খেলা-ধুলার অনুষ্ঠানের উপস্থাপনাও করেছেন। পড়াশোনা করেছেন সমাজ বিজ্ঞান ও অর্থনীতি নিয়ে। সেখানে উচ্চতর ডিগ্রিও আছে।
২০০৭ সালে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক ফুটবল ও ক্রিকেট দলে অভিষেক হয় পেরির। শুরুটা হয় ক্রিকেট দিয়ে। ডারউইনে নিউজিল্যান্ডের সেই ম্যাচে দুই উইকেট পাওয়ার পাশাপাশি ১৯ রানও করেছিলেন ষোড়শি এই অলরাউন্ডার।
সেই বছর চার আগস্ট হংকংয়ের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ খেলতে নেমেও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তার প্রতিভা। ৮-১ ব্যবধানে জয়ের সেই ম্যাচে ডিফেন্ডার হয়েও করেছিলেন একটা গোল।
দারুণ দুটি সূচনার পর তাহলে পিছনে ফিরে তাকানো কেন?
ঢাকার মাটিতে অনুষ্ঠিত সেই ফাইনালেও নিলেন দুটি উইকেট, শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করে ছিলেন ৩১ রানে অপরাজিত। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচেই ছিলেন সমান উজ্জ্বল। ১০৬ রান আর ৮ উইকেট নিয়ে মাতিয়ে গেলেন বাংলাদেশ।
একই সাথে দু’ধরনের খেলা চালিয়ে যাওয়া তো আর মুখের কথা নয়। তাই সমন্বয় করতে প্রায়ই ঝামেলায় পড়েন পেরি। ২০১০ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার জন্য খেলতে পারেননি এএফসি ওমেন্স এশিয়া কাপ। ২০১৪ সালে যেমন খেলতে পারেননি ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত দু’টি ম্যাচ।
২০১৩ সাল অবধি তিনি খেলেছেন আন্তর্জাতিক ফুটবল। জাতীয় দলের হয়ে ১৮ টি ম্যাচ খেলে করেছেন দু’টি গোল। আর পেশাদার ফুটবল খেলেছেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত। এরপর মন দেন ক্রিকেটেই। এক সাথে তিনি দুই নৌকায় পা রাখেননি।
তাঁর টেস্ট ব্যাটিং গড় প্রায় ৮৭। টেস্ট বোলিং গড় ২০-এর নিচে। ওয়ানডেতে ব্যাট করেছেন ৫০-এর ওপর গড় নিয়ে, বোলিং গড় ২৫-এর মত। পাঁচটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছেন। ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছেন একবার। উইজডেনের মতে তিনি ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে পরিপূর্ণ ক্রিকেটার। আরেকটু এগিয়ে বললে তিনি নারীদের ক্রীড়া-ভুবনের সিবি ফ্রাই।
সেটা যাই হোক না কেন, মাত্র এইটুকু জীবনটাকে এতোটা বর্ণাঢ্য করে তুলেছেন যে অস্ট্রেলিয়ান একটি ব্যান্ড দল তাকে নিয়ে গান রচনা করে ফেলেছে — ‘দ্য এলিস পেরি সং’। গানের কথা গুলো অনেকটা এরকম, ‘খুব সম্ভবত তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিভাবান মানুষ। তিনি হলেন জ্যাক ক্যালিস আর পেলের সংমিশ্রণ!’
আমরা বরং কোন তুলনায় না যাই। যার জীবনে এতো অর্জন তাকে চেনাতে আর অন্যদের কথা টেনে আনার কি দরকার!