কি একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্য দিয়ে আমরা পার করলাম গত প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে। কি অনবদ্য এক দ্বৈরথ দেখে নিলাম। মনের প্রশান্তি হলো, চোখ জুড়ালো, বিতর্ক হল লক্ষ্যাধিক। তবুও দিনশেষে লিওনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোতেই মেতে ছিলাম আমি, আপনি আমরা সকলে। তবে বিগত বছর দুই-তিনেক ধরেই একটা গুঞ্জন উঠেছিল সেই গুঞ্জন হয়ত সত্যি হয়ে গেল।
লিওনেল মেসির বয়সটা এখন ৩৪ এ পা দিয়েছেন। অন্যদিকে রোনালদো রয়েছেন ৩৭ বছরে। রৌদ্রজ্জ্বল দিন ঢলে পড়েছে গোধূলি লগ্নে। উত্তাপ কমেছে, পশ্চিম কোণ ধরে স্বর্ণালী বর্ণ জানান দিচ্ছে অতীতের সব অর্জন। যে অর্জন মাতিয়ে রেখেছিলো গোটা একটা বিশ্বকে। তবে সেই গোধূলি লগ্ন যে এক বিদায় বার্তা জানায়। আর সে বিদায় বার্তা চিরন্তন এক সত্য।
গুঞ্জন উঠেছিল মেসি-রোনালদো যুগের অবসান হতে চলেছে। তবে আমি যদি বলি সে যুগের অবসান ইতোমধ্যে হয়ে গেছে তাহলে কি খুব বেশি ভুল করা হয়? বোধকরি না। একটা বার একটু স্মৃতিতে উঁকি মেরে দেখে বলুন তো গত দুই বছরে এই দুই মহারথীর অর্জনটা ঠিক কি? অনেক হাতরেও হয়ত কোন উত্তর খুঁজে পাবেন না। এবার তো একেবারে হাতে নাতে প্রমাণ মিলে গেল। দুইজনের দলই বাদ ইউরোপ ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মঞ্চ উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে।
তাছাড়া গত দুই বছরের পরিসংখ্যানও সেই কথাই বলে। আগে মেসির কথাই ধরে নেওয়া যাক। এবারের মৌসুমের দলবদল শত ভক্তের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করিয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন ফ্রান্সে। সেখানে তিনি কেমন দিন পার করছেন সে কথায় পরে যাওয়া যাক। তাঁর আগের মৌসুমে তাঁর চেনা ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে তিনি স্বাভাবিক গোল করেছেন গোল করিয়েছেন। তবে সমস্যাটা হয়েছে বড় ম্যাচে তাঁর নিষ্প্রভতা।
গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেই কোথাও একটা হারিয়ে যান মেসি। এইতো সেদিন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে রিয়ায়ল মাদ্রিদের বিপক্ষে একেবারেই মেসি সুলভ খেলার দেখা মেলেনি। এটা অবশ্য প্যারিস সেইন্ট জার্মেই-তে আসার পর থেকেই হচ্ছে। বোধকরি মেসি নিজেকে এখানে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছেন না। তাছাড়া ২০২০/২১ মৌসুমে মেসি লা লিগা এবং বাকি সব ম্যাচ মিলিয়ে খেলেছেন ৪৭টি।
সেই ৪৭টি ম্যাচে তাঁর অবদান ৫২ গোলে। নিজে করেছেন ৩৮টিতে। আপনি হয়ত এখন তেড়ে আসবেন, রেগে যাবেন। প্রশ্ন করবেন মেসি কি করে তাহলে শেষ। আর তাছাড়া বার্সেলোনার তখনকার দলটাও তো আর তেমন শক্তপোক্ত কোন দল ছিল না। হ্যাঁ, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সে মৌসুমে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইর কাছে হেরেছিল বার্সেলোনা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডেই। যদিও সেই ম্যাচের দুই লেগেই গোল পেয়েছিলেন তিনি। একটি আবার পেনাল্টি থেকে।
তবে মেসি যে এককালে একাই ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখতেন তা তো দেখেছেন। বিশ্বাস না করারও উপায় নেই। সে মেসিকে কি আদৌ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে গেল বছর দু’য়েকে। তারার মেলা পিএসজি। সে পিএসজির হয়েও কি ম্যাচ জেতাতে পারলেন মেসি? ওদিকে রোনালদোরও ঠিক একই দশা। যে অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদকে একাই হারিয়ে দিতেন নিয়ম করে। সেই রোনালদো এবার একেবারেই অনুজ্জ্বল। আর আগের মৌসুমেও একই দশা ছিল তাঁর।
পোর্তোর সাথের ম্যাচে অ্যাওয়ে গোলের নিয়মের মারপ্যাঁচে জুভেন্টাস হেরে বাদ হয়েছিল দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে। সেবারের দুই ম্যাচে রোনালদোর গোল নেই। এবারের দুই লেগেও নেই গোল। বয়স তো হয়েছে মশাই। তবুও টটেনহামের বিপক্ষে ম্যাচ ঠিকই বের করে নিয়েছিলেন রোনালদো। করেছিলেন একেবারে পুরোদস্তুর রোনালদো সুলভ হ্যাট্রিক। কিন্তু এই যে গোল এলো, তাও তো এলো মাসখানেকের ব্যবধানে।
তাছাড়া আগের মৌসুমে ৪৪ ম্যাচ খেলা রোনালদো করেছেন ৩৬ গোল। সংখ্যার বিচারে নেহাৎ খারাপ না। তবে ওই যে মেসি রোনালদোর সেই জৌলুশের বড্ড অভাব। এখন বলে কয়ে ম্যাচ জেতানোর সামর্থ্য আর নেই। আগে যেমন সবখানেই মেসি কিংবা রোনালদোর বন্দনা হতো এখন আর তা হয় না। তর্ক আর আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন অন্য কেউ। কখনো কিলিয়ান এমবাপ্পে, কখনো আর্লিং হ্যালান্ড কিংবা করিম বেনজেমা, রবার্ট লেওয়ান্ডস্কি।
মেসি-রোনালদোর দাপট হচ্ছে শেষ। ওই যে সন্ধ্যের স্তিমিত হওয়া সূর্যের মতো বয়স বাড়া যে এক চিরন্তন সত্য। সেই সত্যের বলি এখন ফুটবলের সর্বকালের সেরা দুই খেলোয়াড়। অনেকের হয়ত মেনে নিতে কষ্ট হবে। যে মেসি-রোনালদো আরো কিছুদিন থেকে যাবেন স্বগৌরবে। তবে গৌরবে না হোক হয়ত টিকে যাবেন তাঁরা। তবে সেভাবে হয়ত টিকে থাকার ইচ্ছেটা নেই গোটা বিশ্ব ফুটবল থেকে শুরু করে দর্শকদের মনের শাসন করা মেসি কিংবা রোনালদোর।
আমরা যেমন সন্ধ্যে হলেই ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরি, তেমনি আমাদের তারকাদের বাড়ি ফিরতে হবে। ক্লান্তি গ্রাস করেছে। বাড়ি তবু ফিরবেন ক্লান্ত মেসি-রোনালদো ঠায় করে নেবেন সমর্থকদের মনিকোঠায়।