জিম্বাবুয়ে, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী

ক্রিকেট রূপকথার সাগরে ভেসে যেতে চান? তাহলে পাকিস্তানের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের ব্রাড ইভানসের করা শেষ ডেলিভারিটি বারবার দেখুন। ইয়র্কার লেন্থে বল। শাহিন আফ্রিদি সজোরে চালালেন। কিন্তু ব্যাটে বলে হল না।

ক্রিকেট রূপকথার সাগরে ভেসে যেতে চান? তাহলে পাকিস্তানের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের ব্রাড ইভানসের করা শেষ ডেলিভারিটি বারবার দেখুন। ইয়র্কার লেন্থে বল। শাহিন আফ্রিদি সজোরে চালালেন। কিন্তু ব্যাটে বলে হল না।

তারপরও ম্যাচ বাঁচাতে দু’বার উইকেটে প্রান্ত বদল করতে হবে। শাহীন শাহ আফ্রিদি একবার প্রান্ত বদল করে অপর প্রান্তে যেতেই আঁটকে গেলেন সিকান্দার রাজা আর রেজিস চাকাভার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রান আউটে। পাকিস্তান ম্যাচটি হেরে গেল।

আর আবেগ, উচ্ছ্বাসে উন্মত্ত হয়ে উঠলো জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা। ব্রাড ইভানস তো ম্যাচের নাটকীয় পরিস্থিতির পরিণয় টা বুঝতেই পারলেন না। চারপাশের উচ্ছ্বাস দেখে পড়ে গেলেন ঘোরের মধ্যে। তাই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন যাতে করে কিছুটা বাস্তবতায় ফেরা যায়। 

ওদিকে পমি এমবাঙ্গার মাইক্রোফোনে তোলা সুরে ততক্ষণে বরোডেল থেকে বুলাওয়ে, মাউন্ট প্লিজেন্ট থেকে মুতারের সকল মানুষ জেনে গেছে বিশ্বকাপের মঞ্চে জিম্বাবুয়ের কাছে ধরাশয়ী পাকিস্তান। আগের বার বিশ্বকাপ না খেলার গ্লানিতে ভোগা আফ্রিকার দেশটির কাছে এটিই তো সেরা অনুভূতি।

একেই তো বলে পুনর্জাগরণ। এমন মুহূর্তে বাড়তি উচ্ছ্বাস মোটেই অতিরিক্ত নয়। বরং সময়ের অনুভূতি সেই সময়ের বৃত্তেই সেরে ফেলা উচিত। সেটার রেশ নাহয় পরবর্তীতে বৃত্তের বাইরের চলে আসুক। 

শুধু একবার ভাবুন। অস্ট্রেলিয়ার স্টেডিয়ামে একটি ম্যাচ। কিন্তু সেখানে ম্যাচ শেষে জিম্বাবুয়ের দর্শকরা এক কর্ণার থেকে আরেক কর্ণারে নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে। পরভূমে এসে জিম্বাবুয়ের এমন দৃশ্যের সাথে পরিচিতি কারোরই তেমন থাকার কথা না।

তবে অস্ট্রেলিয়াতে এসে মাস খানেকের মধ্যেই এমন উদযাপন জিম্বাবুয়ের সমর্থকরা করলো দুইবার। বিশ্বকাপ শুরুর আগে একবার হোবার্টে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে, আরেকবার পার্থের মাটিতে পাকিস্তানকে হারিয়ে। এটাকে এখন পুনর্জাগরণ বলবেন নাকি রূপকথা? 

দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া আফ্রিকার কোনো দেশেরই ক্রিকেটে তেমন দৌরাত্ম্য নেই। কেনিয়া তো সেই কবেই আঁধারে মিশে ক্রিকেট থেকে বিলীন হয়ে গেছে। সেই পথে জিম্বাবুয়েও হাটতে পারে, এমন শঙ্কাও করেছিল অনেকে।

তবে ক্রিকেটে নিজেদের পদচ্ছাপ কি এত সহজেই মুছে দিতে চায় জিম্বাবুইয়ানরা। তারা ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শুধু নামমাত্র কামব্যাকেই ক্ষান্ত থাকেনি তারা। বড় দলকে নির্ভয়ে চ্যালেঞ্জ জানানোর মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামে তারা। এই যেমন বাংলাদেশের বিপক্ষে গ্যাবায় সামনের ম্যাচের আগেই এক ধরনের হুমকি দিয়েই রেখেছেন সিকান্দার রাজা। 

জিম্বাবুয়ের মতো দলগুলো এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ক্রিকেটে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু ক্রিকেটের কাঠামোয় তো বৈষম্য নামক শব্দটাও তো আছে। বড় দলগুলোর অহংয়ে ছোট দলগুলো ব্রাত্য হয়ে থাকে। আর আইসিসির উদাসীনতা তো আছেই। এ জন্য ক্রিকেটের বিশ্বায়ন এখনো হয়ে ওঠেনি। 

জিম্বাবুয়ের কথাটায় বিবেচনা করা যাক। ইংল্যান্ড সবশেষ ২০০৭ সালে জিম্বাবুয়ে গিয়েছিল সিরিজ খেলতে। এরপর ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও জিম্বাবুয়ের মাটিতে তারা কোনো দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলেনি।

আবার বাংলাদেশ ব্যতিত তেমন কোনো দেশেই সফরে যাওয়ার সুযোগও জিম্বাবুয়ের মেলে কম। ভারতে তারা সবশেষ সিরিজ খেলতে গিয়েছিল দুই দশক পেরিয়ে ২১ বছর আগে, ২০০১ সালে। এমনকি টেস্ট দল হওয়া স্বত্ত্বেও টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপে তারা নেমে গিয়েছে দ্বিতীয় স্তরে। একটি টেস্ট প্লেয়িং দলের অবনমন হওয়ার জন্য এসব সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূলতায় তো যথেষ্ট। 

তবে আফ্রিকার দেশটি তো আর শত প্রতিকূলতায় থেমে যাওয়ার নয়। জীবনযুদ্ধের প্রতিকূলতা যাদের নিত্যদিনের সঙ্গী, তাদের কাছে ক্রিকেট মাঠের সীমাবদ্ধতা আর এমন কী! জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে ফিরেছে। এক ঝাক তারুণ্যের মিশেলে নতুন এক জিম্বাবুয়েকে দেখছে ক্রিকেট বিশ্ব। সিকান্দার রাজার কথাই ভাবা যাক। জন্ম জিম্বাবুয়েতে না। তারপরও জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট আকাশ রক্ষার কাজে কতটা দৃঢ় তিনি, কতটা প্যাশনেট হয়ে তিনি ক্রিকেটটা লালন করেন। এটা অনবদ্য এবং অনিন্দ্য সুন্দর। 

ব্লেসিং মুজারাবানি। এক দশক আগে হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে এসেছিলেন কোনো জুতো ছাড়াই। ছেলেটা জানতোও না, ক্রিকেট মাঠে একটি ম্যাচ খেলার জন্য খেলোয়াড়দের নির্দিষ্ট কিছু সরঞ্জাম থাকতে হয়। সেই ছেলেটিই এখন গতির ঝলকে পুরো বিশ্বকে মুগ্ধ করছেন। জিম্বাবুয়ে ছাড়াও খেলার সুযোগ মিলছে বিভিন্ন দেশের ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট। 

বাবা ক্রেইগ ইভানস যখন জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলতেন তখন ব্র্যাড ইভানস ৫ বছরের শিশু। বাবা খেলেছেন জিম্বাবুয়ের স্বর্ণযুগে। কিন্তু পুত্র ক্যারিয়ার শুরু করলেন জিম্বাবুয়ের একদম আঁধার যুগে। তবে ঠিকই বাবাকে আবার স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনলেন।

যে পার্থে বাবা ক্রেইগ ইভানস তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেছিলেন, সেই পার্থেই পুত্র ব্র্যাড ইভানস ক্যারিয়ারের সেরা ওভারটা করে পাকিস্তানের বিপক্ষে জিম্বাবুয়েকে ম্যাচ জেতালেন। এ তো দারুণ এক উপলক্ষ। পিতা-পুত্র, দুই ইভানসের জন্যই অনুপম সৌন্দর্য্যের এক দৃশ্য। 

পাকিস্তান-জিম্বাবুয়ে ম্যাচে পাকিস্তানের শেষ ৩ বলে যখন ৩ রান প্রয়োজন ছিল তখন ইএসপিএন ক্রিকইনফো তাদের উইন প্রেডিক্টরে জানিয়েছিল, জিম্বাবুয়ের জেতার সম্ভাবনা ৩ %। দিনশেষে সেই প্রেডিকশনকে ভুল প্রমাণ করেছিল সিকান্দার রাজারা।

অরূণোদয়ের তারুণ্যের গল্প লিখেছিল তারা। আর সেই দৃশ্যের অগ্নিসাক্ষী হয়েছে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। ক্রিকেট পরিমন্ডলে এমন ম্যাচজয় হয়তো বড় কিছু নয়। কিন্তু এমন উত্থান, আবেগ, উন্মত্ততা- আমাদের ভাবায়। কখনো কখনো মুগ্ধতার আবেশে আক্রান্ত করে। ক্রিকেটে এমন উত্থানের গল্প আরো উঠে আসুক। আমরাও সেই মোহনীয় দৃশ্যের সাক্ষী হই।  

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...