১৯৭৮। মারিও ‘এল ম্যাটাডোর’ কেম্পেস। করডোবার আরেক গোল্ডেন বয় ড্যানিয়েল বারতোনি। রেফারি সার্জিও গোনেল্লার লম্বা বাঁশি। ৩-১ ব্যবধানে ডাচদের থেমে যাওয়া টোটাল ফুটবলের ছন্দ। জেগে ওঠা এল মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামের রানিং ট্র্যাকে কেম্পেসদের ভিক্টোরি ল্যাপ।
আলিবসেলেস্তে সমর্থকদের ফেটে পড়া উল্লাসে কান পাতা দায়। আর্জেন্টিনা জিতেছে তাদের প্রথম বিশ্বকাপ, তাও ঘরের মাঠে। সেই বিশ্বকাপ কেবলই একটা অর্জন নয়, আর্জেন্টাইনদের কাছে ছিল গ্রীষ্মের দীর্ঘ খরতাপের পর এক পশলা স্বস্তির বৃষ্টি। তপ্ত মরুতে তৃষ্ণার্ত, ক্লান্ত-শ্রান্ত বেদুইনরা যেভাবে শান্তির বাড়ি খুঁজে বেড়ায়, তেমনি ফুটবলকে কেন্দ্র করে আর্জেন্টাইনরাও একটু শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
কারণ বুয়েনোস আইরেসের এই স্টেডিয়ামের আশেপাশেই ছিল অসংখ্য টর্চার সেল। নেপথ্যে স্টেডিয়ামের ভিআইপি স্ট্যান্ডে বসে থাকা প্রেসিডেন্ট রাফায়েল ভিদেলা আর তার স্বৈর শাসন। ফলাফল; ৩০ হাজার আর্জেন্টাইন কেবল ভিন্ন মতের হওয়ায়, বিদ্রোহী হওয়ায় রীতিমত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
পুরো দেশটার হয়ে ওঠা জীবন্ত নরক, মার্সিলেস টর্চার সেল। লাশের গন্ধ মিশে থাকা বাতাসে গোটা একটা বিশ্বকাপ জিতে ফেলা তো মচ্ছবের উপলক্ষ না হয়ে যায় না। তাই বলে এতগুলো প্রাণ চলে যাওয়াটাও ভুলে যাওয়ার উপায় নেই। ’৭৮ বিশ্বকাপটা এমনিতেও নানান কারণে বিতর্কিত। সেই গল্প আরেকদিন।
আজ ‘এল ফ্লাকোর’ গল্পটা একটু করে বলি। লিকলিকে গড়নের এক ভদ্রলোক। নাম সিজার লুইস মেনোত্তি। শারীরিক গঠন হালকা-পলকা হওয়ায় যার ডাকনাম, ‘এল ফ্লাকো’। যার লম্বা চুল নেমে এসেছে ঘাড় অবধি। কেতাদুরস্ত। ফুটবল তো ভালোবাসতেনই। ভালোবাসতেন ধুমপান করতেও। তর্জনী-মধ্যমার মাঝখানে একটা জ্বলন্ত সিগারেট যেন তার সিগনেচারই ছিল।
ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শী। স্বভাবে দার্শনিক। ভিদেলাকে দেখতেই পারতেন না। কথিত আছে, বিশ্বকাপ ট্রফিটা নেয়ার সময় ভিদেলার সাথে হ্যান্ডশেকটাও করেননি। নিজের বিশ্বাসে তো আঘাত লাগতে দেয়া যাবে না। স্বভাবে ছিলেন দার্শনিক। কোচিংয়ে এর প্রভাবটা ছিল চরম। ক্যারিয়ারের পুরোটাই নিজের বানানো পথেই হেঁটেছেন, হাঁটিয়েছেন শিষ্যদের।
দার্শনিক’ মেনোত্তির একটা প্রকট ছাপ পাওয়া যায় তার ফুটবল দর্শনেও। দর্শন আর শিল্পের মিশেলে গড়া নিজের সেই ট্যাকটিকসকে মেনোত্তি বলতেন ‘বামপন্থী ফুটবল’। যেখানে ত্যাগ আর সংগ্রামই শেষ কথা। তার মতে, বামপন্থী ফুটবল ঠিক যাপিত মানবজীবনের মতো; যেখানে শত প্রতিকূলতা এলেও জয় ছিনিয়ে আনতে হয়।
মেনোত্তি বিশ্বাস করতেন, প্রতিষ্ঠিত একজন ফুটবলারের কাজ কেবল বুটের ছোঁয়ায় হাজার হাজার দর্শককে আনন্দে ভাসানোই নয়। বরং ফুটবল পায়ে মানুষের স্বপ্ন-অনুভূতির ভাষান্তরও করা। সেই বিশ্বাসটা শিষ্যদের মাঝে ইঞ্জেক্ট করে দিয়ে তাদের খেলাতেন, ওয়ান টাচ মুভমেন্ট, নাটমেগ, ওভারল্যাপ আর দৃষ্টিনন্দন পাসিংয়ে।
যদিও আর্জেন্টিনা তখন বিশ্বাসী ছিল আগ্রাসী, গতিময়, শরীরী ফুটবলে ; মোদ্দাকথায় যেটা ‘এন্টি-ফুটবল’ নীতি। বহুল চর্চিত সেই ‘এন্টি-ফুটবল’ নীতির বাইরেও যে খেলা যায় আর্জেন্টিনাকে মেনোত্তিই দেখিয়েছিলেন। বিশাল চ্যালেঞ্জই নিয়েছিলেন ভদ্রলোক।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ছন্দময় ফুটবলের স্বপ্নটা তার ভেতরে জাগিয়েছিল ব্রাজিলের ‘সত্তরের ‘ড্রিম টিম’। এক বন্ধুকে নিয়ে মেক্সিকোতে সেবার বিশ্বকাপ দেখতে গিয়ে ব্রাজিলের চোখ জুড়ানো খেলার প্রেমে পড়েছিলেন মেনোত্তি।
সুন্দর ফুটবলই মেনোত্তির শেষ কথা ছিল। ফল যেমনই হোক, খেলার সৌন্দর্যটা থাকা চাই বাপু! ফ্লুইড বল মুভমেন্ট আর পাসিংকে ভরসা করে যে দারুণ ছন্দে দলকে ফুটবল খেলাতেন, সেটাই হয়ে উঠেছিল চর্চিত বিষয়।
পাসিং ফুটবলে তার বিশ্বাস ছিল প্রকট, শিষ্যদেরও বলতেন গোলও একটা পাসই। শুধু সতীর্থের জায়গায় গোলপোস্ট সেটা আটকাচ্ছে। এই ধারণাকেই উপজীব্য করেই একটা লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছিলেন মেনোত্তি। যেখানে অর্জনের চেয়ে তার প্রভাবের রোশনাই বেশি; গানের সুরের মতো ছন্দময় ফুটবল, হাতে আঁকা নিখুঁত একটা ছবির মতো নিখুঁত পাসিং।
‘
‘দ্য বিউটিফুল গেম’ খ্যাত ফুটবলের বিশাল মঞ্চে মেনোত্তিও অন্যতম এক চরিত্র। দার্শনিক, ধূমপায়ী তো বটেই খানিকটা উদাসীও বলা চলে। তার চেয়ে ভালো টেকনিক-ট্যাকটিক্সের কোচও আর্জেন্টিনা পেয়েছে। কেউ সফল হয়েছে, কেউ ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে সরে দাঁড়িয়েছে।
কারো ট্রফি ক্যাবিনেট হয়তো তার চেয়েও ভারী। হয়তো ম্যারাডোনার ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠার ‘৮৬ বিশ্বকাপটাই আর্জেন্টাইন সমর্থকদের কাছে স্মরণীয়। বিশেষজ্ঞদের যতই আপত্তি থাকুক সিজার লুইস মেনোত্তির কোচিংয়ের ধরন কিংবা দর্শন নিয়ে, যে উত্তাল সময়ে মেনোত্তির দলটা বিশ্বকাপ জিতেছিল, সেটার সাথে কোনো কিছুর তুলনা হয়?
ইতিহাস স্বাক্ষী, ১৯৭৮ সালে নরকে পরিণত হওয়া আর্জেন্টিনায় স্বস্তি ফিরিয়েছিল মেনোত্তির দল। যতই তর্ক-বিতর্ক হোক, সেখানেই স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে; আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুইস সিজার মেনোত্তি। যার লিকলিকে শরীরের ঘাড় অবধি নেমে এসেছে চুল। চিন্তিত চেহারায় দার্শনিকতার ছাপ, তর্জনী-মধ্যমার ফাঁকে গুঁজে রাখা জলন্ত সিগারেট আর মাথাভর্তি চিন্তা, কীভাবে ফুটবলটাকে আরও সুন্দর করে খেলা যায়।
এই মোড়ে এসে আবির্ভাব কার্লোস বিলার্দোর। ’৮২-তে মেনোত্তি যেখানে শেষ করেছিলেন, বিলার্দোর শুরু সেখান থেকেই। বিলার্দো আবার দর্শনের ধার ধারতেন না। তার ফুটবলের একটাই সংজ্ঞা, জিততে হবে, জিততে হবে, প্রথম হতে হবে। ভুলত্রুটির জায়গা নেই একদমই।
ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। ’৮৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনার তৃতীয় গোলটা ম্যারাডোনার থ্রু থেকে করেছিলেন বুরুচাগা। গোল করে বুরুচাগা ছুটে গেলেন টাচ লাইনের দিকে, দুই হাঁটু গেড়ে বসে কৃতজ্ঞতা জানালেন আকাশ পানে হাত তুলে।
ডাগ আউট থেকে মাঠের দিকে ছুঁটছিলেন কোট-টাই পরা কেতাদুরত্ব এক ভদ্রলোক। তিনি আর্জেন্টিনার কোচ কার্লোস সালভাদর বিলার্দো। ব্যস! অ্যাড্রেনালিন রাশে ওই ভোঁ-দৌড়ই তার উদযাপন। শেষ বাঁশি বাজলে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতলো ৩-২ ব্যবধানে। ম্যারাডোনা হয়ে উঠলেন ঈশ্বর। আর্জেন্টাইনরা দ্বিতীয়বার পেল ওই স্বর্ণালি ট্রফির ছোঁয়া। তবুও ভাবান্তর নেই আর্জেন্টাইনদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতানোর নেপথ্যের কারিগর বিলার্দোর।
দল যখন উত্তাল উদযাপনে ব্যস্ত, পুরো আর্জেন্টিনা যেখানে একবার ছোঁয়া পেতে চায় অমূল্য সেই ট্রফির, বিলার্দো হাতের কাছে পেয়েও তা ছুঁয়ে দেখেননি। (পরে অবশ্য ফিফার ইন্টারভিউতে হাতে নিয়েছেন) মেডেলটাও নেননি, অথচ তার কোচিং ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিলেন সেদিন। কারণ কী? ফাইনালে আর্জেন্টিনার জালে জার্মানির দুই গোল ঢুকেছিল কর্নার কিক থেকে। ব্যাপারটা একদমই হজম হয়নি কোচ বিলার্দোর। ব্যস!
ফুটবল রোমান্টিসিজম আর বাস্তবতার প্রশ্নে মেনোত্তি-বিলার্দোকে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করানোই যায়। রাজনীতি, ফুটবল দর্শন, ট্যাকটিকস কিংবা ব্যক্তিত্বে দুজনই ছিলেন দুই মেরুর মানুষ। তবুও দুজন মিলেছেন এক বিন্দুতে। তাদের হাত ধরেই আর্জেন্টিনা দুইবার ঘরে তুলেছে বিশ্বকাপ।
মেনোত্তি ছিলেন নান্দনিক ফুটবলের পূজারি। তার সেই দর্শনে ফলাফল যাই হোক, সুর-তাল-লয়ের দৃষ্টিনন্দন পাসিং ফুটবলই তার শেষ কথা। অন্যদিকে, বিলার্দোর মাঝে ফুটবলের রোমান্টিকতা ছিল না সেভাবে। বাস্তববাদী এই মানুষটির দর্শন ছিল, যেভাবেই হোক ম্যাচ জেতা চাই। অর্থাৎ ফল কেন্দ্রিক ফুটবলই তার দর্শনের মূল ভিত্তি।
মেনোত্তি ছিলেন ‘অ্যান্টি ফুটবল’-এর ঘোর বিরোধী। কিন্তু বিলার্দোর ফুটবল ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ আর কোচিংয়ের পুরোটা কেটেছে এই ‘অ্যান্টি ফুটবল’ নীতির পথে। দুই কোচের দুই দর্শন। তবুও দুইবারই চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা।
দুজনকে নিয়ে ’৮৬ বিশ্বকাপের পর দুইভাগে ভাগ হয়েছিল গোটা আর্জেন্টিনা; ‘মেনোত্তিজম’ আর ‘বিলার্দিজম’ নিয়ে। দুজন ছিলেন ল্যাটিন দেশটার সকল ফুটবল দর্শনের সেতুবন্ধন, ছিলেন সূক্ষ্ম ডিফারেন্সিয়াল লাইনটা। যেখানে দুজনই রেখে গেছেন নিজেদের কীর্তি, কীর্তিতে খোদাই করা আছে তাদের নাম। তাই তো দুজন এখনো প্রাসঙ্গিক।
এবার রইলেন লিওনেল স্ক্যালোনি। মেনোত্তি-বিলার্দোর কাতারে বসতে বাকি এক ম্যাচ, ৯০ কিংবা ১২০ মিনিট। তাকে নিয়ে কিছু লিখছি না এখন। কী তার দর্শন, কীভাবে খেলানো পছন্দ সবই তো চোখের সামনে ঝুলছে সবার, এক সার্চে হাজিরও হয় সব কিছু। তবুও স্কালোনিকে জানার, লেখার, চর্চার, জানানোর বাকি।
এই এক ম্যাচের পর স্কালোনির নামের পাশে স্তুতি কিংবা ট্র্যাজেডিক কিছু শব্দ জুটে যাবে। আমি স্তুতি গাথাই লিখতে চাই অবশ্য। ট্র্যাজিক হিরো এবার অন্য কেউই হোক! আজ থেকে কয়েক দশক পর যেন স্কালোনিও আমার মতো অসংখ্য মানুষের লেখায় চিন্তায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন; দার্শনিক আর বাস্তববাদী দুটো মানুষের মতোই।