ক্যাম্প ন্যু, বার্সার ঘরের মাঠ। সমর্থকদের মুখে মুখে বিচরণ করে ক্লাব কিংবদন্তিদের নাম। স্লোগান, গান আরো কত কি যে হয় ক্যাম্প ন্যু এর গ্যালারি জুড়ে। সবকিছুর পেছনে কারণ সেই একটাই, খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেওয়া, প্রতিপক্ষকে মনে করিয়ে দেওয়া মাঠের এগারো জনই নয়, তাঁরা লড়ছেন প্রায় লাখ খানেক দর্শকের বিপক্ষেও।
কিন্তু কাতালান সমর্থকেরা একবার বেজায় ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। সেবার রীতিমত সব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছিলেন রাগে ফুসতে থাকা সমর্থকেরা। কি করেন নি সেবার, প্রতিপক্ষের গাড়ি বহরে আক্রমণ, মাঠের ভেতরে উচ্ছিষ্ট নিক্ষেপ করা থেকে শুরু করে গগন বিদারী চিৎকারে ধিক্কার জানিয়েছিলেন। এসব কিছুর পেছনের কারণ ছিলেন একজন, সেই মানুষটি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর অগ্রজ। পর্তুগাল ফুটবলের ইতিহাসের একজন কিংবদন্তি।
১৯৭২ সন বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষে নিজেদের সামলে নেবার চেষ্টা চালাচ্ছে ঠিক তখন পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে ইউরোপের একটি স্বাধীন দেশে জন্মেছিলেন তিনি। চৌঠা নভেম্বর পর্তুগালের আলমাদা শহরে। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে ইউরোপে নন্দিত ফুটবলার লুইস ফিগো।
ফিগোর ফুটবলের হাতেখড়ি অথবা পায়েখড়ি সেটার শুরু ফুটসাল থেকে। ফুটসাল এক বিচিত্র খেলা। মোটে পাঁচ কি ছ’জনের একেক দল লড়ে একে অপরের বিপক্ষে। ফুটবলের ন্যায় গোল করাই যার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু আকারে, পরিধিতে ছোট সময়ের দিক বিবেচনাতেও ঘন্টার অর্ধেক সময় খেলা হয় সাধারণত। আকারে ছোট মাঠে খেলা হলেও এই খেলাতে চাই প্রচুর পরিমাণে ফুসফুসের দম। ছোট মাঠে দৌড়াতে হয় প্রতিনিয়তই। একটুখানি জিড়িয়ে নেবার সুযোগ নেই। ছুটতে হবে পুরো সময়টা জুড়েই।
দমের পাশাপাশি আরো চাই অভাবনীয় বল নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এবং ফুটবলীয় শৈলী। খুব ছোটবেলা থেকেই ফিগো যুক্ত ছিলেন ফুটসালের সাথে, আমরা এখন যেমন যুক্ত হয়ে যাই মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের স্ক্রিনের সাথে।
এসবের স্ক্রিনের সাথে সংযুক্ততায় ভাল কোন ফলাফল বয়ে আনে কিংবা আনে না, বিষয়টা আপেক্ষিক। কিন্তু ফুটসালের সাথে সম্পৃক্ততা ফিগোর জীবনে নিয়ে আসে সম্ভাবনার নতুন দাঁড়। মাত্র তের বছর বয়সেই ফুটসালের ছোট্ট মাঠ থেকে তাঁর স্থান হয় তাঁরই দেশের অন্যতম সেরা ক্লাব স্পোর্টিং সিপির ডেরায়। ১৯৮৫-৮৯ এই চার বছর ক্লাবটির যুব দলের হয়ে নিজেকে শান দেওয়ার কাজটি সেড়ে নেন লুইস ফিগো।
১৯৮৯/৯০ মৌসুমেই তাঁর অভিষেক ঘটে মূল দলে। খানিকটা সময় নিয়ে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নেন মূলদলে। স্পোর্টিং সিপির ক্যারিয়ারের পাশাপাশি ফিগোর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারও সমান তালে চলতে থাকে। পর্তুগাল ফুটবলের স্বর্ণালী দিনের একজন খেলোয়াড় তিনি সতেরো বছরেই ডাক পান জাতীয় দলে। তবে অভিষেক ঘটে তারও বছর দুই বাদে।
এর আগে অবশ্য পর্তুগাল বয়স ভিত্তিক দলের হয়ে তিনি নিজের অর্জনের পাখায় পালক হিসেবে ১৯৮৯ এর ইউয়েফা অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপ ও ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন তিনি। ফিগোর সঙ্গি ছিলেন রুই কস্তা ও জোয়াও পিন্টো। পর্তুগালের স্বার্ণালী প্রজন্মের তিন পথিকৃৎ।
তা বেশ ভালই ছিলেন ফিগো স্পোর্টিং সিপিতে। ১৯৮৯-৯৫ পর্যন্ত ক্লাবের হয়ে সব মিলিয়ে খেলেছিলেন ১৫৮ ম্যাচ। খেলতেন মধ্যমাঠে, গোলের ক্ষুধা নেহাৎ কম কিংবা করানোর ইচ্ছেটা প্রখর তাই গোল সংখ্যা মোটে ২৩টি।
তারপর ফিগো চিন্তা করলেন এবার একটু ঘুরে দেখা যাক ইউরোপীয় ফুটবলের পরাশক্তিদের ঘরগুলো। যেই ভাবা সেই কাজ তিনি ছুটলেন ইতালির উদ্দেশ্যে। তবে আনন্দে আত্মহারা কিংবা দিকনির্দেশনা বড্ড অভাব থেকে করে বসলেন এক ভুল। ভুলটা শেষমেশ ফুলে রুপান্তরিত হয়। জুভেন্টাস ও পালমোর সাথে সমান্তরাল চুক্তি করায় তাঁকে ইতালিতে দু’বছর নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি তো নিজের ঘর ছেড়েছিলেন ঘুরে বেড়ানোর জন্য, নিজেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রমাণে। তিনি কি আর নিষেধাজ্ঞা মাথায় নিয়ে বসে রইবেন?
না তিনি যথারিতি বসে রইলেন না। চলে গেলেন তিনি স্পেনের বার্সেলোনা শহরে। খুঁজে বেড়ালেন নতুন অস্তিত্ব। ভাগ্য বিধাতার কি অদ্ভুত এক প্রেম তাঁর উপর। জায়গা পেয়ে গেলেন শহরের অন্যতম সেরা ক্লাবটিতে, এফসি বার্সেলোনাতে। নিয়তির খেলায় ভুলগুলো সব ফুল হয়ে যায়।
কাতালানদের হয়ে খেললেন পাঁচ মৌসুম। কাতালানদেরকে নেতৃত্ব দেবার সৌভাগ্যও হয়েছিল ফিগোর। ঘরের ছোট্ট ছেলেটির মত আদর যত্নের কমতি ছিল না। দর্শক-সমর্থকদের মধ্যমণি ছিলেন, পাশাপাশি ছিলেন দলে প্রাণ-ভোমরা। কিন্তু সুখের সংসারে আসে ভাঙন ৷ এই ভাঙনের দায় রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজকে বয়ে নিতে হয়েছে বহুকাল। এখনো তাঁকেই ধরা হয় বার্সা-ফিগোর ভালবাসার গল্পের খলনায়ক।
১৯৯৯/২০০০ মৌসুমের মধ্যভাগে রিয়ালে পাড়ি দেবার আগে ফিগো বার্সার হয়ে ২৪৯ ম্যাচ। সব ধরণের প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলে তার বার্সা খাতায় লেখা রয়েছে ৪৫টি গোল। গোল আর ম্যাচের পরিসংখ্যান বাদেও তার শিরোপা জয়ের কীর্তিও রয়েছে বার্সার হয়ে। কাতালান ক্লাবটির হয়ে ফিগো রিভালদো আর ক্লাইভার্টের সাথে জুটি বেঁধে জিতেছিলেন পরপর দু’বার লা লিগা ও কোপা দেল রে থেকে শুরু করে ইউয়েফা সুপার কাপও।
২০০০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি এর বিনিময়ে তিনি যোগ দেন তারই প্রাক্তন ক্লাবের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের শিবিরে৷ এর আগে রিয়াল মাদ্রিদের সভাপতি নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রার্থী ফ্লরেন্তিনো পেরেজের নির্বাচনী ইস্তেহারে ফিগোকে দলে ভেড়ানো ছিল প্রধান শর্ত।
পেরেজ জিতে যান। এতে ফিগোর চাহিদা সেসময়ের ইউরোপিয় ফুটবলের বাজারে কেমন ছিল তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। তখনকার সময়ে প্রায় ষাট মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ফিগোকে স্পেনের রাজধানীর ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে ভিড়িয়ে নিজের নির্বাচনী ইস্তেহারের শর্ত বাস্তবায়ন করে সমর্থকদের আস্থা জিতে নেন পেরেজ।
কিন্তু অপরদিকে ফিগো হয়ে যান বার্সা সমর্থকদের চোখে বিষ। যে সন্তানকে তাঁরা ভালবাসতেন, স্নেহ আদর করতেন সেই সন্তান কি না বিশ্বাসঘাতকতা করে প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে চলে গেলেন? এ কি মেনে নেওয়া যায়? তাই কি কখনো সহ্য হয়?
সেসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল বার্সার সমর্থকরাই ৷ রিয়াল বনাম বার্সার ক্যাম্প ন্যু তে অনুষ্ঠিত একটি খেলাকে কেন্দ্র করে পুরো বার্সেলোনা শহর যেন পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। কড়া পুলিশি পাহারায় পুরো রিয়াল মাদ্রিদ দলকে সরাসরি এয়ারপোর্ট থেকে নেওয়া হয় মাঠে। তবুও হামলার হাত থেকে রেহাই পায়নি রিয়ালের বাসটি। ইট, কাচের বোতলের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় বাসের জানালার কাচ। আতংকিত খেলোয়াড়ে মাঠে পৌঁছান। খেলা শুরু হয়। কিন্তু সেবার যেরকম গ্যালারি দেখেছিল রিয়াল মাদ্রিদ খেলোয়াড়েরা সেরকম বোধহয় খুব কমই ঘটে থাকে ফুটবলে৷
পুরো গ্যালারিতে দুয়োধ্বনি চলছে অনবরত। ঘরের খেলোয়াড়দেরকে উৎসাহ দেওয়ার থেকেও সেদিনটাকে কাতালান সমর্থকেরা বেছে নিয়েছিলেন একজন খেলোয়াড়কে নাজেহাল করতে। তিনিই ছিলেন ফিগো। এমনকি সেবার পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে খেলা বন্ধ রাখতে হয়েছিল মিনিট পনেরো ৷
তবে এতসব ধিক্কার, নিন্দা ছাপিয়েও ফিগো ছিলেন অমলিন। রিয়ালের জার্সিতেও ছিলেন দাপুটে, খেলেছেন মধ্যমাঠের ত্রাস হিসেবেই। ফুটসালে শিখে আসা শৈলী কাজে লাগাতেন ঘাসের বড় মাঠে। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইতেন সমর্থক, দর্শকরা। এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারতেন লুইস ফিগো।
রিয়ালের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি সবধরনের প্রতিযোগিতামূলক খেলা মিলিয়ে অংশ নিয়েছিলেন মোট ২৪৫ ম্যাচ, গোল করেছিলেন ৫৮। লস ব্ল্যানকোসদের হয়ে ফিগো দুইবার লা লিগা, একবার চ্যাম্পিয়নস লিগ, ও একবার ইউয়েফা সুপার কাপ থেকে শুরু করে বহু শিরোপা দিয়ে সুসজ্জিত করেছিলেন নিজের অর্জনের তাক।
ফিগো তাঁর নৈপুণ্য, বার্সা-রিয়াল দুই দলের হয়েই তাঁর প্রতাপশালী পারফরম্যান্সের জন্য ২০০০ সালে জিতে নেন ব্যালন ডি’অর।
খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারের শেষ দিকটায় তিনি চলে যান ইতালিতে। ইতালির ক্লাব ইন্টার মিলানের হয়ে চারবার লিগ শিরোপা জিতেন পর্তুগালের এই কিংবদন্তি। ২০০৮/০৯ মৌসুমে শেষ লিগ শিরোপা জিতে নিজে নন্দিত কিংবা নিন্দিত ক্যারিয়ারের ইতি টানেন লুইস ফিগো।
এর আগে পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়ে ১৯৯১-২০০৬ অবধি ১২৭টি ম্যাচে অংশ নেন ফিগো। ৩২টি গুরুত্বপূর্ণ গোলও করেন দেশের হয়ে। কিন্তু কোন এক মধ্যরাতে নিশ্চয়ই ফিগোর মনে কোন এক কোণা থেকে জাগ্রত হওয়া কোন এক আফসোস তাকে বিষণ্ণ করে তোলে। আফসোস জাতীয় দলকে কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতাতে না পারার আফসোস, আফসোস দেশের মানুষদেরকে উৎসবের আনন্দে ভাসিয়ে না দিতে পারার আফসোস।
ভাগ্য বিধাতা যে সবক্ষেত্রে প্রসন্ন হবেন তা নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিষ্ঠুর হয়ে যান তিনি৷ এই নিষ্ঠুরতাকে ভুলে যেতে চান হয়ত ফিগো। তবে তিনি তাঁর ফুটবলীয় শৈলীতে ছিলেন অনন্য, অনবদ্য, অসম্ভব সুন্দর! সেখানে ভাগ্য বিধাতার নিষ্ঠুরতা পৌঁছাতে পারে না। সেখানটার পুরোটা জুড়েই থাকে ফুটবলের আশীর্বাদ আর নিজের কঠোর পরিশ্রম।
তাই হয়ত বিষণ্ণতার রাতে তাঁর ক্লাব ক্যারিয়ারের অর্জনগুলোর কথা মনে করে একটু হালকা হওয়ার চেষ্টা করেন ফিগো। তারপর দূর গগনের পানে চেয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন ভুল গুলোর জন্য।