অমল আলোয় অমল ধারা

১৯৯৪ সালের ২৮ মার্চ। ভারতের পশ্চিম উপকূলে সূর্য সবে মাথার উপর যেতে শুরু করেছে। মেরিন ড্রাইভের পাশেই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ২২ গজে গতকাল দিনের শেষ আলোয় যে লড়াই চালিয়েছিলেন, আজ সকালে তা আবার শুরু করেছেন এক পোড় খাওয়া যোদ্ধা। নাম তাঁর উৎপল চ্যাটার্জি। ১৯৩-তে অল আউট হবার পরে উৎপলের উপর ভর করেই বাংলা ম্যাচে ফিরে আসবে।

শেষ পাঁচ ওভারে তিন উইকেট তুলে নিয়েছেন তিনি, মুম্বাই ৪১-এ তিন। সকালে সুনীল মোরেকে হালকা স্পিনে অফস্টাম্প শুইয়ে দেওয়ার পরই প্যাভিলিয়নে উঠে দাঁড়ালেন এক তরুণ, সেই বছরই তাঁর রঞ্জি অভিষেক হয়েছে হরিয়ানার বিরুদ্ধে নাহার সিং স্টেডিয়াম, ফরিদাবাদে। ধুঁলো মাখা উইকেটে অভিষেকেই যতীন পরঞ্জাপের সঙ্গে দেড়শ রানের পার্টনারশিপ দিয়ে শুরু।

তারপর আবার রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে সোয়া দুশো রান এবং সমীর দিঘের সঙ্গে পৌনে দুশো রানের পার্টনারশিপ দিয়ে ছেলেটি যখন পঙ্কজ ঠাকুরের নির্বিষ অফস্পিনে স্টাম্পড হলেন ততক্ষণে স্কোরবোর্ডে তাঁর নামের পাশে লেখা হয়ে গিয়েছিল ২৬০ রান। ভারতীয় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড এই সেদিন পর্যন্ত তাঁর নামের পাশে ছিল। অমল মজুমদার নাম, দ্বিতীয় দিন সক্কাল সক্কাল যখন পপিং ক্রিজের দুদিকে দু পা দিয়ে লেগ স্টাম্প গার্ড নিয়ে দাঁড়ালেন, তখন উৎপল চ্যাটার্জী বাঘ হয়ে দেখা দিয়েছেন। যেন তাঁর প্রতি হওয়া সমস্ত বঞ্চনার জবাব আজকেই বল হাতে দেবেন তিনি।

অমল কোয়ার্টারফাইনালে খেলেননি। কিন্তু সেমি ফাইনালে, পুনেতে মহারাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা পঞ্চাশ এবং আরেকটি অপরাজিত শতরানের ইনিংস খেলেছেন সারদাশ্রম বিদ্যামন্দিরে শচীন টেন্ডুলকার ও বিনোদ কাম্বলির একদা সতীর্থ। সেই যে ৬৬৪ রানের স্কুল ক্রিকেটের বিশ্বরেকর্ড পার্টনারশিপ, সারা পার্টনারশিপ জুড়ে একজন ব্যাটসম্যান ধৈর্য্য পরীক্ষা দিয়ে গেছিলেন। প্যাড পরে বসে থাকার। নামেননি তিনি।

কিন্তু, ধৈর্যের সঙ্গে সহবাসের ভিত বোধহয় তখনই গড়া হয়ে গিয়েছিল। রমাকান্ত আচরেকরের আরেক সুযোগ্য শিষ্য অমল মজুমদার। সেই ধৈর্য, সেই টেকনিক, সেই মনোসংযোগ নিয়ে সোজা ব্যাটে উৎপল চ্যাটার্জী, চেতন শর্মা, প্রশান্ত বৈদ্য, সাগরময় সেনশর্মা এবং অজয় ভার্মার বোলিং খেলতে শুরু করলেন অমল।

রমাকান্ত আচরেকারের ছাত্র, অনূর্ধ্ব ১৯-এ বেশ রান করছেন, ধৈর্য আছে, সোজা ব্যাটে খেলেন, টেকনিক ভালো, এগুলো জুনিয়র ক্রিকেটে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। লোকজন বলছেও যে পরবর্তী শচিন। কিন্তু বললেই তো হয় না। অনুর্দ্ধ ১৯ ভারতীয় দলে খেলা মাত্র ৩০ শতাংশ সিনিয়র ক্রিকেটে সফল হয়। অমল হবেন তো? তাঁর পক্ষে যাচ্ছে মুম্বইয়ের স্থানীয় ক্রিকেট কৃষ্টি। যে কৃষ্টি মন্থন করে বছরের পর বছর ধরে ‘খাড়ুশ’ ব্যাটসম্যানরা উঠে আসেন।

বিজয় মার্চেন্ট, সঞ্জয় মাঞ্জরেকর, সুনীল গাভাস্কার, দিলীপ ভেংসরকার, শচীন টেন্ডুলকার এ নামগুলো তো চেনাই। কিন্তু অমলের প্রথম অধিনায়ক রবি শাস্ত্রীও তো এগারো নম্বরে শুরু করে নিজেকে টেস্ট ওপেনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল একটা ‘চাপাটি’ শট আর কভার দিয়ে ঠেলে দেওয়া ড্রাইভের ওপর ভরসা করে। বিদেশের মাটিতে তাঁর রেকর্ডই কথা বলে। অমল পারবেন তো? প্রি কোয়ার্টারে দ্বিশতরান, সেমিতে দেড়’শ, মঞ্চ তো প্রস্তুত। ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে তরুণ অমল আলোয় ওয়াংখেড়ে রেঙে উঠল।

না সেঞ্চুরি আসেনি। উৎপল প্রস্ফুটিত পদ্ম হয়ে দেখা দিয়ে নিজের বলে মিসটাইমড ড্রাইভ তালুবন্দী করলেন অমলকে। ৭৮এ শেষ হল। কিন্তু প্রথম ইনিংসের গুরুত্বপূর্ণ লিড পেয়ে গেল মুম্বাই এবং দ্বিতীয় ইনিংসে আশ্চর্যজনকভাবে উইকেট সহজ হয়ে গেলে আট উইকেটে জিতেও গেল তারা। আর ভারত যেন মিডল অর্ডারের জন্য এক তারকার খোঁজ পেয়ে গেল।

এই পর্যন্ত গল্পটায় বেশ একটা আলো আলো ভাব রয়েছে, কুঁড়ির পদ্ম হয়ে বিকাশের গল্প রয়েছে। কিন্তু হল কি? অমল মজুমদার আর বছর দুয়েকে ভারতীয় দলে স্থান পেলেন কি? বছর পাঁচেক পরে নিয়মিত হলেন কি? আর সাত বছর পরে লিজেন্ডের পর্যায়ভুক্ত? একটা বিরাট ‘না’ আমাদের জন্য অবাক করে দিয়ে অপেক্ষা করে রইল।

কুড়ি বছর ক্রিকেট খেলে যখন অবসর নিলেন অমল, তখন রঞ্জি ট্রফির সর্বাধিক রানের রেকর্ড তাঁর। কিন্তু ভারতীয় দলে? নাহ কুড়ি বছরেও ভারতীয় দলের হয়ে একট ম্যাচও খেলার সুযোগ পাননি অমল মজুমদার। শচীনের থেকে সামান্য ছোট, তাঁর স্কুল ও রাজ্যদলের সতীর্থ এবং পরবর্তী শচীন হিসেবে আশা জাগানো অমল মজুমদার একবারের জন্যও জায়গা পেলেন না ভারতীয় দলে? কেন?

ছোট ছোট ঘটনা বা দুর্ভাগ্য বলা যেতে পারে। যেমন ৯৬-এর ইংল্যান্ড সফর। লর্ডস টেস্টে দুই তরুণ তুর্কী নিজেদের ভারতীয় দলে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলল, সৌরভ গাঙ্গুলি এবং রাহুল দ্রাভিড়। অথচ অমল মজুমদার কি সুযোগ পেতেন না? ৯৫-এর দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ এবং তারপর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সুযোগ তো পেয়েছিলেন, কিন্তু আহামরি পারফরম্যান্স ছিল না। কিন্তু আসল সুযোগটা এসেছিল ১৯৯৫-৯৬-এর দুলীপ ট্রফিতে।

অমল খুব খারাপ কিছু করেননি। লক্ষ্মণের ৩৯৬ রানের পাশে রাহুলের ৩৫৩ আর অমলের ৩৩৩। সৌরভ করেছিলেন ৩০৮। কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলের বিরুদ্ধে একটা দুর্দান্ত ১৭৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন সৌরভ। আর রাহুল তার আগের দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বিরুদ্ধে বেশ ভালো খেলেছিলেন। শিকে ছিঁড়ল দুজনের। লক্ষ্মণ পর্দার পাশে অপেক্ষায় থেকে গেলেন আর শিকে ছিঁড়ল না অমলের।

আরেকটা সুযোগও এসেছিল। ৯৯-০০ মৌসুমে। ভারতীয় দল তখন ম্যাচ ফিক্সিং-এর করাল পাশে আবদ্ধ। জাদেজা ৫ বছরের জন্য এবং আজহারউদ্দীন আজীবনের জন্য ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলা থেকে বহিষ্কৃত। এবারে সুযোগ পেতে পারতেন অমল, রঞ্জিতে একটা সেঞ্চুরি সহ সাড়ে ছশো রান। খুব যে খারাপ তা কি বলা যায়?

কিন্তু সে বছর দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন ভাঙ্গিপুরুপ্পু ভেঙ্কটসাঁই লক্ষ্মণ। মাত্র নটি ম্যাচে একটি ত্রিশতরান এবং আটটি সেঞ্চুরি সহ চৌদ্দশর উপর রান করলেন তিনি। তার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিডনিতে ১৬৭। ভারতীয় দলের ৩, ৪, ৫ ও ৬ পরবর্তী দশ বছরের জন্য প্রায় নির্ধারিত হয়ে গেল।

অমল যেন ভুল সময়ে জন্মেছেন এবং ভুল সময়ে রান করতে পারেননি। আসলে মুম্বইতে সামান্য শতরানে হয় না। লোকে নড়েচড়ে বসে ম্যামথ শতরান করলে। ঠিক একই ব্যাপার অমলের সঙ্গেও ঘটল। রঞ্জির রানগুলো ডাইনোসর হয়ে ঠিক সময়ে দেখা দিল না।

হতাশায় ২০০২-এ খেলা ছাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম অধিনায়ক রবি শাস্ত্রী ও শচীন টেন্ডুলকার আটকালেন। মুম্বাই ক্রিকেটের কথা চিন্তা করে অমলের আরও খেলে যাওয়া উচিৎ। খেলে গেলেন অমল ২০০৬-০৭ অধিনায়কত্বও করলেন। সে বছরের শুরুটা আবার খুবই খারাপ হয়েছিল। বাংলা এবং পাঞ্জাবের সঙ্গে প্রথম ইনিংসের লিড খোয়ানোর পর হায়দ্রাবাদের সঙ্গে হেরে গেল মুম্বই। ৩ ম্যাচে ০ পয়েন্ট। চাকা ঘোরা শুরু পরবর্তী গুজরাট ম্যাচ থেকে।

রবি শাস্ত্রীর সাথে অমল

খুব বেশি নয়, কিন্তু খুব প্রয়োজনীয় অর্ধশতরানের একটি ইনিংস খেলেন অমল। পরের রাজস্থান ম্যাচে সেঞ্চুরি। সেমি ফাইনালে বরদার বিরুদ্ধে একটা ৯৭ কিন্তু এই ম্যাচেই মুম্বাই দ্বিতীয় ইনিংসে শূন্য রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল। তবু সমীর দিঘের ৬৬র দৌলতে ফাইনালে পৌঁছায় মুম্বাই। আর তারপর যা হয় আর কি, মনোজ তিওয়ারি এবং সৌরভ গাঙ্গুলি একটা মরণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অমলের নেতৃত্বে জয়ের মুকুট ওঠে মুম্বাইয়ের মাথায়।

সোজা ব্যাটে খেলা অমল মজুমদার, প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শোনা যে এতটাই সোজা ব্যাট যে অফ স্পিনারকে পপিং ক্রিজ বরাবর ফ্রন্টফুট নিয়ে ড্রাইভও করেছেন। সেই সোজা ব্যাটে খেলা অমল মজুমদারের মুম্বাইকে দেওয়ার দিনও ফুরিয়েছিল। ২০০৯-১০ এর আগে সেই কারণে বুচিবাবু ক্রিকেটে মুম্বই দলে ঠাঁই হল না। আইপিএল-এও তাঁর কথা ভাবা হয়নি। টেকনিকালি সঠিক ক্রিকেটার মানে পাজামা ক্রিকেটে অচল, এ তো বহুদিন হয়েই আসছে।

কিন্তু, ক্রিকেট দেওয়া তখনও বাকি থেকে গেছিল বোধহয়, তাই আসাম অন্ধ্র ঘুরে আরও চার বছর পরে যখন যবনিকা নেমে এলে বাইশ গজে তখন রঞ্জির সর্বাধিক রান তাঁর জিম্মায়। যদিও পরে তাঁরই দীর্ঘদিনের সতীর্থ ওয়াসিম জাফর পেরিয়ে যান তবুও। শিখরে উঠে খেলা শেষ করলেন অমল।

যদিও সেই শিখর বছর কুড়ি আগে ভাবা শিখর নয়, তবুও প্রতিটি ধাপের একেকটা নিজস্ব শিখর আছে, যেমন প্রতিটি পথের থাকে একটি নিজস্ব গন্তব্য। সেই গন্তব্যে হয়তো প্রতিবার স্বর্গ পাওয়া যায় না। কিন্তু নিজের মতো করে সন্তুষ্টি থাকেই। এরপরের ইতিহাস নিয়ে বেশি ঘেঁটে লাভ নেই। ভারতীয় দলের ট্যাগ গায়ে লাগেনি। তাই ভারতীয় দলের ব্যাটিং কোচ বা চিফ কোচ তিনি হন না। কিন্তু নেদারল্যান্ডস বা আইপিএল দল অথবা নিদেনপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং পরামর্শদাতা হবার জন্য সেই ট্যাগ জরুরি নয়।

কিছু কিছু স্বপ্ন পূর্ণতা পায় না, কুঁড়ির থেকে প্রস্ফুটিত পদ্মের প্রকাশের আগেই হারিয়ে যায় কোথাও না কোথাও। কিন্তু প্রতিটি ফল্গুধারা অন্ত:সলিলা হয়ে বইতে থাকে, নিজস্ব সাগরে মিশে যান তাঁরা সময়ে। অমল এমনই এক স্রোত, এমনই এক আলো। যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আলোকিত করল না হয়তো, কিন্তু জগতের প্রকাশে ঠিক নিজের যোগদান রেখে গেল, নিজের মতো করে।

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link