কেকেআর কানেকশান, কবেকার এ বন্ধুত্ব!

কলকাতা নাইট রাইডার্স নামটা যখন মহাসমারোহে বঙ্গজীবনে ঢুকে এল তখন এই শতকের প্রথম দশক শেষ হয়ে আসছে। কলকাতা শহরে সৌরভ-চ্যাপেল তরজা নিয়ে নিউজপ্রিন্ট খরচ করছে সংবাদমাধ্যম। ঢাউস মনিটারের ডেস্কটপ কম্পিউটার থেকে পাতলা একটা প্লেটের মতো বস্তু ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে।

কলকাতা নাইট রাইডার্স নামটা যখন মহাসমারোহে বঙ্গজীবনে ঢুকে এল তখন এই শতকের প্রথম দশক শেষ হয়ে আসছে। কলকাতা শহরে সৌরভ-চ্যাপেল তরজা নিয়ে নিউজপ্রিন্ট খরচ করছে সংবাদমাধ্যম। ঢাউস মনিটারের ডেস্কটপ কম্পিউটার থেকে পাতলা একটা প্লেটের মতো বস্তু ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে।

ল্যাপটপ। নোকিয়ার কি-প্যাড ফোনের পাশ দিয়ে রকেটের গতিতে উঠে আসছে মাল্টিমিডিয়া ফোন। টেলিকম ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত টাটা নিয়ে আসছে ডোকোমো। এয়ারসেল, ইউনিনরের মতো কোম্পানি আসছে বাজারে। আর অদ্ভুত সেই সময়টার মধ্যে আমাদের কৈশোরের নরম মাটি খুঁজছিল একটা ছাপ। যে ছাপ অনেকে এনেছিল, কখনও রোনালদো, কখনও মেসি, কখনও ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, কেকে-সোনুর গান, শাহরুখের ডন-হৃত্বিকের ধুম টু, আর এনেছিল কেকেআর!

একটা অদ্ভুত গান। ‘করব-লড়ব-জিতব রে’ – কয়েক এমবি খরচ করে সে গান ঢুকে এল আমাদের মোবাইল ফোনে। আমাদের শহরের একটা দল। ক্যাপ্টেন সৌরভ। নিজের বাবার নামের (প্রশান্ত সাহা) জার্সি গায়ে ঋদ্ধিমান সাহা, অশোক দিন্দা সঙ্গে ম্যাকালাম-শোয়েব। আমরা কেবল ভাবছিলাম, আদৌ কেমন হবে খেলাটা?

কেমন হবে এমন একটা হযবরল ফর্ম্যাট? ললিত মোদী রাতারাতি নায়ক। কে কে আর ঝড়ের মতো শুরু করেও কিছু করে উঠতে পারল না প্রথম সিজনে। কিন্তু একটা জিনিস কে কে আর পেরেছিল তা হল কলকাতার আবেগকে কাজে লাগিয়ে একটা বাঙালি দর্শকবেস৷ ঐ সময়ের কৈশোরের মাটিতে পাকাপাকি ছাপ।

পরের আইপিএল চলে গেল আফ্রিকায়। সৌরভ-বুকানন-ম্যাককালাম দ্বন্দ্ব। জঘন্য পারফরমেন্স। ম্যাচের আগে অনেকে বললেন জার্সিটা কালো, অপয়া৷ বদলে হল বেগুনী। একটা কোটি টাকার ফ্র‍্যাঞ্চাইজি টুর্ণামেন্টেও নাকি বাঙালির চিরন্তন পয়া-অপয়া। হায়! তাও ব্যাপারটা ফাইনালি হল।

সবটা বদলে গেল ২০১২ তে। গৌতম গম্ভীর। সঙ্গে এক বিস্ময় বোলার। যাকে পড়া যায় না। নারিন। সুনীল নারিন। কোনও এক আচমকা ঝড়ের মতো-মনবিন্দর বিসলা! কলকাতার চ্যাম্পিয়ন হওয়া। শহরে ফেরার পর কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টির দোকান থেকে এল নানা রকম নাইট রাইডার্স থিমের মিষ্টি।

কলকাতার অনেক জহুরির থেকে এল সরকারী উদ্যোগে দেয়া সোনার চেন। শাহরুখ নাচলেন বাংলা গানের তালে। দলটা যেন আরও আরও বাঙালির হয়ে গেল, যে রেশটা নিয়েই আরও একটা ট্রফি এল ২০১৪ সালে। মানিশ পাণ্ডের মাস্টারক্লাস। এ রাজ্যে সদ্য আসা শাসকদলের নেত্রীর ঘোষণায় শাহরুখ হয়ে গেলেন বাংলার ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসাডার।

কলকাতা নাইট রাইডার্স ততদিনে যেভাবে ডিজিটালাইজেশন হয়েছে, বিবর্তিত হয়েছে সেভাবেই। ক্রমশ রেডিও চ্যানেল, টিভি থেকে রাস্তায় হোর্ডিং-প্ল্যাকার্ডে এসে গেছে সোনালী-বেগুনি রঙ, মোবাইল রিংটোনে- ‘করব লড়ব জিতব রে…’

এই জয়ের পরবর্তী সময়টা মজার। অপেক্ষার। কিন্তু একটা জিনিস কে কে আর এই পোস্ট ২০১৪ সময়ে ধরে রেখেছিল তা হল বিশ্বাস। আজকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর হার্শা ভোগলে যখন রিঙ্কুর দিকে মাইক এগিয়ে দিলেন, রিঙ্কু বলল আমি এই দলটার সাথে আছি ৭ বছর, আমার কাছে এটাই পরিবার এখন।

নীতিশ রানা বলছেন- আমার কাছে নাইট রাইডার্স কী আমি জানি না, জিজি ফিরে আসার পর আমি ওঁকে একটা চিঠি লিখেছিলাম- ও শুধু বলেছিল আমার ফিরে আসাটা জরুরি না, ঐ পোডিয়ামে একসাথে দাঁড়িয়ে ট্রফি জেতাটা জরুরি।

যেমন আন্দ্রে রাসেল, চোটের জন্য দিনের পর দিন মেডিকেল এক্সপেন্সের বিল বহন করেছে কে কে আর, আমেরিকায় সার্জারি থেকে রিকভারি- রেখে গেছে বিশ্বাস, এমনকি আগের দু’সিজনে অফ ফর্মে থাকার পরেও নারাইন-রাসেলের ওপর বিশ্বাস করে যাওয়া কে কে আর, ভেঙ্কি আইয়ার-বরুণ চক্রবর্তীকে শত গঞ্জনার পরেও রিটেইন করা কে কে আর, স্টার্ককে ২৪.৭ কোটিতে কেনা কে কে আর, অঙ্গকৃশ রঘুবংশীকে তিন নাম্বারে নামিয়ে আর্ধেক আই পি এল খেলা কে কে আর- এই গত সাত-আট বছরে বিশ্বাস রেখে গেছে- প্ল্যানিং-এ বিশ্বাস।

মানুষে বিশ্বাস। অ্যাবিলিটিতে বিশ্বাস। একদিন ঠিক পারবে- এইটুকু বিশ্বাস। আজ পেরেছে৷ এই আই পি এল দেখল, আই পি এলের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে ডমিনেটিং পারফরম্যান্স!

যে কলকাতা নাইট রাইডার্স কালো-সোনালি জার্সিতে ১৬ বছর আগে এসেছিল, সে কে কে আর আজ বদলে গেছে অনেক। সেই দল, সেই জার্সি সবটুকুই বদএল গেছে। যেমনটা বদলে গেছি আমরাও। স্কুল পেরিয়ে, কলেজ পেরিয়ে, এখন তিরিশের দোরগোড়ায়।

কিন্তু, এই বিবর্তনবাদের সবচেয়ে বড় ভিত্তিখানা কে কে আর আজও লালন করে তা হল বিশ্বাস – কালো টি শার্টের চুলে স্পাইক করা মধ্য চল্লিশের শাহরুখের উদ্দাম গ্যালারি সম্মোহন বদলেছে শেষ-পঞ্চাশের লম্বা চুলের কোনও দার্শনিকের প্রাজ্ঞে যে চ্যাম্পিয়ন হলে মাঠে নেমে এসে শান্তভাবে জড়িয়ে ধরেন প্লেয়ারদের।

যেন, এই দলের কাঠামোয় বেঁধে দেয়া তারই বিশ্বাস এখনও স্নায়ুতে ধরতে পারেন তিনি। যে বিশ্বাস বলে- ‘আগার কিসি চিজ কো সাচ্চি দিল সে চাহো তো পুরি কিয়ানত উসসে তুমসে মিলানে কি কোশিস মে লাগ জাতি হ্যায়…’

এত বছর পর, এত দূর থেকেও, ভেঙ্কি আইয়ারের উইনাং রানটার পর আমরা প্রতিধ্বনি ছুঁড়ে দিচ্ছি দলটার দিকে, আমাদের কৈশোরের কত স্মৃতির দিকে, কত কত ফেলে আসা মনখারাপের দিকে। ঐ যে তিনি বলেছেন- ‘কানেকশান ভি না কামাল কি চিজ হ্যায়৷ ব্যস, হো গ্যায়া তো হো গ্যায়া…’

এ কানেকশান, কবেকার এ বন্ধুত্ব, বেঁচে থাক, বেঁচে থাক, বেঁচে থাক!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...