ছুটছেন কপিল দেব। অবশ্য আপনারা বলবেন এ আর নতুন কথা কী? তিনি তো সেই ছোটবেলা থেকেই ছুটে এসেছেন। কখনও বল করার জন্য, কখনও আউটফিল্ড থেকে বল কুড়াবার জন্য, কখনও ভিভের পুলের পেছনে ছুটেছেন, কখনও বা উইকেটের মাঝখানে রান চুরি করবেন বলে ছুটেছেন।
তবে আমি যে ছোটার কথা বলছি সেই ছোটা একটু অন্য ধরনের। স্প্রিন্ট নয়, এই ছোটা ম্যারাথন। কপিল তখন ছুটছেন হ্যাডলির বিশ্বরেকর্ড ভাঙবেন বলে। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি উইকেট দখলের রেকর্ড।
আজকের ক্রিকেট প্রেমীরা কপিলের সেই ছোটার পেছনের অলৌকিক দু:সাহসের কথা কল্পনাও করতে পারবেন না। না পারার কারণ তারা বুমরাহ, শামি, উমেশ, ইশান্তদের প্রাচুর্য দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু যে যুগে কপিলের পদার্পণ ঘটেছিল তখন জোরে বোলিং বলে কোন বস্তু ভারতীয় ক্রিকেটে ছিল না।
ছিল না কোন রোল মডেল যাকে অনুসরণ করে নিজেকে একজন ফাস্ট বোলার উদ্বুদ্ধ করবেন। বা যার কাছ থেকে রিভার্স স্যুইং বা লেগ কাটার বল করার শিক্ষা গ্রহণ করবেন। আর সবার ওপর ছিল ভারতের ধূলিধূসর পিচ। বুক বা মাথা নয়, এই পিচে কোমরের ওপর বল তুলতেই হিমসিম খেয়ে যেতেন ফাস্ট বোলাররা।
তবুও কপিল ছুটেছেন। ইতিহাস, ভূগোল, যুক্তি – সবকিছু উপেক্ষা করেই ছুটেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারবেন কি? বলের গতি কমে আসছে। হাঁটুতে অলরেডি অন্তত চারবার অস্ত্রপচার হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। বল ছোঁড়ার আগে তাই কপিলের লাফ আর ততটা জোরালো নয়। বলে গতি আর বাউন্স আনার জন্য আগের মতো পিঠের ওপর চাপও তিনি দেন না।
তবু ১৯৯১-৯২এর অস্ট্রেলিয়া সিরিজে দুটো পয়েন্ট বোলার কপিলের পক্ষে ছিল। এক, টেস্ট ক্রিকেট থেকে প্রায় এক বছরের বিশ্রাম। দুই, অস্ট্রেলিয়ার প্রাণবন্ত পিচ।
প্রথম টেস্টে অবশ্য ভারত বেশ কোণঠাসা। মাত্র ২৩৯ রানে গুঁটিয়ে গেছে ইনিংস। উত্তরে অস্ট্রেলিয়া যথেষ্ট শক্ত খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে – ২৪৪/২। এবার নতুন বল নিল আজাহারের ভারত। এবং তারপরই কপিলের হাত থেকে পরপর যেন তিনটি কবিতার লাইন বেরিয়ে এল।
ব্যাট হাতে কপিলের সামনে দাঁড়িয়ে অ্যালান বর্ডার – সেই সময়কার পৃথিবীর অন্যতম সেরা ব্যাট। তার ওপর তিনি বাঁহাতি। অর্থাৎ কপিলের ন্যাচারাল আউট স্যুইঙ্গার তার কাছে ইন স্যুইঙ্গার।
কার্যক্ষেত্রে হলও তাই। বর্ডারের অফ স্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে পড়ে ভেতরের দিকে গোঁত্তা খেয়ে বল খুঁজে নিল তার ব্যাট আর প্যাডের মধ্যকার ফাঁক। কপিলের সতীর্থরা একে একে ছুটে এসে অভিনন্দন জানালেন কপিলকে। কপিলের মুখেও পামলিভ মার্কা চওড়া হাসি।
এবার নামলেন ডিন জোন্স। কিছুদিন আগেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পরপর দুটি দ্বিশত রান হাঁকিয়ে ফর্মের তুঙ্গে রয়েছেন। কয়েক বছর আগে উনি টেস্টেও দ্বিশত রান হাঁকিয়ে ছিলেন – মাদ্রাজের বিখ্যাত টাই টেস্টে। সেই সিরিজে একটাও উইকেট পান নি কপিল।
কিন্তু, মাদ্রাজ আর ব্রিসবেন এক নয় তার প্রমাণ অচিরেই পেলেন জোন্স। মিডল স্ট্যাম্পে পড়ে স্যুইং করে জোন্সের এগিয়ে দেওয়া ব্যাট এবং অফ স্ট্যাম্প – দুটোকেই ফাঁকি দিয়ে উইকেটরক্ষক মোরের হাতে আশ্রয় নিল বলটি। উইকেট দখলের আনন্দ প্রকাশের জন্য দুই হাত তুলেও মাঝপথে থেমে গেলেন কপিল।
সম্ভবত উপলব্ধি করলেন বলটি জোন্সের পক্ষে একটু বেশি রকম ভালো হয়ে গিয়েছিল। সানি বা বয়কটের মতো ব্যাটসম্যান হয়ত ব্যাটের কানা লাগিয়ে ক্যাচ দিয়ে ফিরে আসতেন সেই বলে। না, সেই বল ছাড়ার মতো দুঃসাহস দুজনের কেউই দেখাতে পারতেন না।
পরের বল। এবার আর আগের ভুল করেন নি কপিল। আগের বারের কাছাকাছি পিচ করলেও এবার আর অফ স্ট্যাম্পের বাইরে নয়, অফ স্ট্যাম্পকেই নাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল কপিলের আউট স্যুইঙ্গার।
মাঠের শ্রেষ্ঠ আসন অর্থাৎ নন স্ট্রাইকার এন্ড থেকে এই কাব্যাংশের দর্শক ছিলেন বহু যুদ্ধের যোদ্ধা ডেভিড বুন। তিনি পরে জানান পরপর তিনটি এত ভালো বল তিনি নিজের ক্রিকেট জীবনে আর দেখেন নি। আমরাও দেখেছি কি?
বলা বাহুল্য, এই সিরিজে পাঁচ টেস্টে মোট ২৫টি উইকেট নিয়ে ৪০১ উইকেটে পৌঁছে যান কপিল। আমরা উচ্ছ্বসিত। অবশেষে কপিলও হ্যাডলিরই মতো আবার ম্যাচ জেতাতে শুরু করবেন এবার থেকে।
ভারতের সেই আশা পুরণ হয় নি। পরের ৩৩ উইকেট পেতে আরও ১৬ টি টেস্ট খেলার প্রয়োজন হয়েছিল ভারতের চিরশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটারের। অনেকটা শচীনের ১০০ সেঞ্চুরির মতো, কপিলের সেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌঁড় দেখতে ভালো লাগেনি আমাদের মতো অনেক কপিল ভক্তদের।