আপনার পছন্দের ব্যাটসম্যান কে?
কোনো ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থককে এই প্রশ্ন করলে অনেক রকম উত্তরই পাওয়া যাবে। সিকে নাইডু, লালা অমরনাথ থেকে বিজয় মার্চেন্ট, পলি উমরিগার থেকে সেলিম দুররানি, কিংবা মহিন্দর অমরনাথ থেকে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, সুনীল গাভাস্কার থেকে দিলীপ সারদেসাই – অনেক উত্তরই পাওয়া যাবে। বেশিরভাগই হয়তো ঘুরে ফিরে শচীন টেন্ডুলকার, মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, রোহিত শর্মা কিংবা বিরাট কোহলি’র নাম বলবেন। এই আলোচনায় আসেন না দিলীপ ভেঙসরকার।
যদিও, এই যুগে বসেও মনে হয় – তাঁকে নিয়ে আলোচনা আরো বেশি হওয়া উচিৎ। ভারতের অন্যতম ‘ফাইনেস্ট’ ও গ্রেসফুল এই ব্যাটসম্যান নিয়ে নিয়ে আলোচনা হওয়ার অনেক কারণ আছে। হেডিংলির সেই মৃত্যুকূপে ১৯৮৬ সালে দুই ইনিংসে ৬১ ও ১০২ কিংবা লর্ডসের মাঠে টানা তিন সেঞ্চুরি – তিনি তো আলোচিত হবেনই। কেন হন না – সেটা একটা বিস্ময়!
বিশ্বের যে কোনো ক্রিকেট দল তাঁদের ব্যাটিং লাইন আপের সেরা ব্যাটসম্যানকে রেখে দেয় তিন নম্বর পজিশনের জন্য। আর সেই দল যদি হয় ভারত তাহলে তো ইতিহাসেরই এক অধ্যায় খুলে বসতে হয়। অজিত ওয়াদেকাররা তিন নম্বর পজিশনের যে লিগ্যাসি চালু করে গিয়েছিলেন তা মহিন্দর অমরনাথ, রাহুল দ্রাবিড়দের হয়ে আজকের বিরাট কোহলিরা এখনো বয়ে চলেছেন।
তবে, সেই মহারথীদের তালিকায় সবচেয়ে কম উচ্চারিত হওয়া এক নাম দীলিপ ভেঙসরকার। অথচ টেস্ট ক্রিকেটে তিন নম্বর পজিশনে ভারতের যে গর্ব, সেই গর্বের অন্যতম কারণ দীলিপ ভেঙসরকার। শুধু সেকালের ব্যাটসম্যান বলে নয় – তাঁর পরিসংখ্যানও একালের যে কারো সাথে দিব্যি সমতুল্য।
১৯৭৫ সালের কথা, তখন অবধি ভারতে জন্ম নেয়া গ্রেট টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান মাত্র অবসরে গিয়েছেন। ভারতের ক্রিকেট ইতিহাস বদলে দেয়া এই অধিনায়ক, তিন নম্বর পজিশনটাও সামলেছেন প্রায় ৮ বছর। তবে তাঁর অবসরের পর হঠাতই যেন মুখ থুবড়ে পড়ে ওই টপ অর্ডার। সে বছরই বোম্বের সাথে পুরো ভারতের একটি ম্যাচ হয়।
তখনকার স্টার ক্রিকেটার একনাথ সোলকার ম্যাচের আগে ইনজুরিতে পড়লে দলে জায়গা পান এক সম্ভাবনাময়ী তরুণ ভেওসরকার। তবে ওই স্পিনিং ট্র্যাকে বিশন সিং বেদির মত স্পিনারদেরকে সামলে সেঞ্চুরি করে ফেলেন ১৯ বছরের সেই তরুণ। সেদিন তাঁর ১১০ রানের ইনিংস দেখে যতটা না মুগ্ধ হয়েছিল সবাই তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল তাঁর ব্যাটিং স্টাইল। তারপরই ভারতীয় দলে সুযোগ পান এই ব্যাটসম্যান।
তবে নির্বাচকরা সিদ্ধান্ত নেয় তাঁকে দিয়ে ওপেন করানোর জন্য। তবে সেই পরীক্ষার ফলাফল খুব একটা সুখকর ছিল না। ওপেনার হিসেবে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ১৩.৭৫। তারপর দ্রুতই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে আসা হয়। অবশ্য রান করতে না পারলেও তাঁর টেকনিক আশা দেখাচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে। ১৯৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে সেই আশার প্রতিদান দেন তিনি।
এরপর থেকে প্রায় এক দশক ভারতে হয়ে তিন নম্বর পজিশনে ব্যাট করেছেন এই গ্রেট ক্রিকেটার। ভারতের মাটিতে তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। দেশের মাটিতে তাঁর ক্যারিয়ার গড় ৫৫.৫৯। দেশের বাইরেও একই রকমভাবে সফল ছিলেন এই ব্যাটসম্যান। তবে তিনি তাঁর সেরাটা রেখে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের জন্য।
১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে নিজের সেরাটাই দেন এই ব্যাটসম্যান। ওই সিরিজে ৯০ গড়ে করেছিলেন মোট ৩৬০ রান। লর্ডসে টানা তিনটি সেঞ্চুরি করার কৃতিত্বও রয়েছে তাঁর। সেই সিরিজের পর ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮৬ সালের ওই ইংল্যান্ড সিরিজের পর থেকে ক্যারিয়ারের সেরা সময় পাড় করেন তিনি। ১৯৮৬-১৯৮৮ সালে তিনি মোট ২০টি টেস্ট খেলেন এবং সেখানে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৯০.০০। ২০ টেস্টে করেন মোট ১৮০০ রান। আশির দশকে ভারতের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন দীলিপ ভেঙসরকার।
১৯৮৭ সালে র্যাংকিং সিস্টেম চালু হলে, র্যাংকিং অনুযায়ী তিনি ছিলেন ওই সময়ে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। সেই সময়ে ভারতের ক্রিকেটে অন্যতম বড় নাম দীলিপ ভেঙসরকার। তবে ১৯৮৯ সালে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে একটি নিষিদ্ধ সিরিজে অংশ নিলে তাঁকে বিচারের আওতায় আনে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রন সংস্থা। সেই সময়ে ছয় জন সিনিয়র ক্রিকেটারকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই)। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আর কখনো সেই চেনা রূপে ফিরতে পারেননি এই গ্রেট ক্রিকেটার।
তবুও, ১৯৯২ সালে অবসরে যাওয়ার আগে মোট ১১৬ টি টেস্ট খেলেছিলেন তিনি। সেখানে ৪১.৩৭ গড়ে করেছিলেন ৬৮৬৮ রান। অবসর নেয়ার সময় সুনীল গাভস্কারের পরে তিনিই ছিলেন ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। তারপরও কেন তিনি কম আলোচ্য একালে? – এটা বিরাট একটা রহস্য!