সোনায় মোড়া কাঠবিড়ালি

ডিস্ক্লেমার দিয়ে শুরু করি – ফুটবল একেবারেই ফলো করি না। যতটুকু ইন্টারেস্ট জন্মেছে তার জন্য দায়ী আর্জেন্টিনার এক খর্বকায় দৈত্য যিনি ১৯৮৬ সালে নিজের বাঁ পায়ের যাদুতে এমনভাবে সমগ্র বিশ্বকে সম্মোহিত করেছিলেন যে একটা তের বছরের ক্রিকেট পাগল কিশোরও এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে এই জিনিস দুর্লভ, এই স্মৃতি সাবধানে জমিয়ে রাখতে হবে।

তারপর মাঝে মধ্যে বিশ্বকাপ দেখতাম। রোনালদোর অত্যাশ্চর্য গোল চেনার ক্ষমতা, রোনালদিনহোর স্কিল, জিদানের রাজসিক আধিপত্য – এই সবের মধ্যে জীবন এগিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে চলছে লিওনেল মেসি এবং আরও এক রোনালদোর যুগ। গত বিশ্বকাপে এই দুজনের প্রতিভার ডুয়েল দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। সেই আশা অবশ্য পূর্ণ হয় নি।

তবে বিনিময়ে যা পেয়েছিলাম সেটাও কিছু কম নয়। ফ্রান্সের কিলিয়ান বাপ্পে নামের এক উনিশ বছরের কিশরের খেলা দেখে মনে হয়েছিল অঘটন না ঘটলে কালে এই ছেলে মারাদোনা – জিদানের পাশে জায়গা করে ফেলবে। ভুল বললাম। নিজের অসাধারণ স্কিলের দৌলতে দলকে বিশ্বকাপ জেতানো যদি ক্রাইটেরিয়া হয় তাহলে অলরেডি সে ওই দুই নক্ষত্রের পাশে জায়গা করে ফেলেছে কিলিয়ান এমবাপ্পে। অন্যদের জানি না, আমার দৃষ্টিতে গত বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার এই ছেলেটাই ছিল।

ভুল বুঝবেন না। ক্রোয়েশিয়ার লুকা মদ্রিচও সেই বিশ্বকাপে অসাধারণ খেলেছিলেন। কিন্তু বাপ্পে যে অন্য স্তরের সেটা বুঝতে ভুল হয় নি। প্রথমেই যেটা চোখে লাগে সেটা হচ্ছে অসম্ভব গতি। বল দখলের লড়াইয়ে ৫০-৫০ বলগুলি প্রায় সবগুলিই সে অনায়াসে দখল করে ফেলে। আর একবার কোন ডিফেন্ডারকে পেরিয়ে গেলে তার পক্ষে আর ওকে ছোঁয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বল কন্ট্রোলও যথেষ্ট ভাল।

ছোট জায়গার মধ্যে ড্রিবল করে বেরিয়ে যেতে সিদ্ধহস্ত। সেই সঙ্গে নিজস্ব কিছু স্টাইল – ছুটতে ছুটতে গোড়ালির ধাক্কায় নিখুঁত পাস, বল রিসিভ করার পর মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে আচমকাই গতির বিস্ফোরণে বিপক্ষকে বেসামাল করে ফেলা, গোল করার পর দুই বগলে হাত দিয়ে সেলিব্রেশান।

তবে এই সবকিছু ছাড়িয়ে দৃষ্টিগোচর হয় ছেলেটার দুর্দান্ত ফুটবল সেন্স এবং অসম্ভব ঠাণ্ডা মাথা। প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ডিফেন্ডার এবং গোলকিপারকে নিয়ে বাপ্পে ছেলেখেলা করছে। যেখানে অন্যরা বুলেটের গতিতে শট মেরে গোল করতে চায়, সেখানে ও আলতো টোকায় বল প্লেস করে – গোলকিপারের ডাইনে, বাঁয়ে, কখনও বা তার মাথার ওপর দিয়ে ছোট্ট, মাপা লব দিয়ে। আর গোল করার পরের সেলিব্রেশানটাও কখনও মাত্রাছাড়া নয়। হাবভাবে বুঝিয়ে দেয় যে ওর কাছে ফুটবলটা খেলাই, জীবন বা ধর্ম নয়। আর সেই জন্যই বোধহয় প্রত্যাশার চাপ এখনও ওর মুখ থেকে হাসি ছিনিয়ে নিতে পারেনি।

এবারের বিশ্বকাপে তাই আমি মেসি, নেইমার বা রোনালদোকে ছাপিয়ে অপেক্ষা করছিলাম বাপ্পে কতটা উন্নতি করেছে সেটা দেখার জন্য। ১৯৮৬তে মারাদোনার বয়স ছিল ২৫, এই বিশ্বকাপে বাপ্পে ২৩। ইতিমধ্যেই ও বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার। বাংলার ফুটবল প্রেমীর মধ্যে ওকে নিয়ে মাতামাতি একটু কম হলেও ও যে এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নাম্বার ফুটবলার সেই বিষয়ে তেমন বিতর্ক নেই। সুতরাং স্টেজ ইজ সেট। এই বিশ্বকাপ বাপ্পের বিশ্বকাপ না হওয়ার খুব জোরালো কোন কারণ নেই।

অবশ্য স্ট্যাটিস্টিক্স বলছে এই ধরনের প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে ভালো দলের জেতার সম্ভাবনা ১২%-এর আশেপাশে। সুতরাং নক আউটে উঠতে সমস্যা না হলেও তারপর যে কোন একটা ম্যাচে ফ্রান্সের ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই আছে। আর এটা কে না জানে, ব্যক্তিগত ভাবে একজন ক্রীড়াবিদ যত ভালোই খেলুন, দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে না পারলে সেই খেলা মর্যাদা পায় না।

তবে আশার কথা এই যে ছেলেটার বয়স এখনও বেশ কম। সুস্থ থাকলে (ঈশ্বর করুন), অন্তত আরও একটা বিশ্বকাপে পূর্ণ শক্তির বাপ্পেকে দেখতে পাওয়া যাবে।

এই বিশ্বকাপে দুটো বড়সড় অঘটন অলরেডি ঘটে গেছে। গতরাত্রে ফ্রান্স – অস্ট্রেলিয়া খেলা আরম্ভের বেশ কিছুক্ষণ পর অব্দি মনে হচ্ছিল আরও একটা ঘটতে চলল। কিন্তু তারপরই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মত খেলতে আরম্ভ করল ফ্রান্স। এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের মত কিলিয়ান এমবাপ্পে। একটা বিদ্যুৎ গতির ব্যাক-হিল পাস।

পেনাল্টি বক্সের মধ্যে আচমকা গতি বাড়িয়ে ড্রিবল করে বেশ কয়েকবার বিপক্ষের ডিফেন্সকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া। তারপর জোরাল হেডে এই বিশ্বকাপের স্কোরকার্ডে নিজের নাম তোলা। কয়েক মিনিট পরেই ঠিকানা লেখা নিখুঁত পাসে গিরডের মাথা খুঁজে নিয়ে তাকে ফ্রান্সের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গোল স্কোরারের পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া।

দিনটা আরও ভালো হতে পারত কারণ এর মাঝে খান দুয়েক সহজ চান্সও নষ্ট করেছে সে। তবে তারপরও হেসেছে। যেন জানে যে আবার সুযোগ আসবে, সে সাফল্যও পাবে। আর না পেলেই বা – খেলা তো!

সব মিলিয়ে বাপ্পের গতরাত্রের ফুটবল যেন অফিসে একটা সাধারন দিনের কাজকর্ম। বা ওয়াক ইন দ্য পার্ক! কিন্তু তাতেই বিশ্বের অন্যান্য দলের কোচ এবং ডিফেন্সের কাছে সতর্কবাণী পৌঁছে গেছে। এই স্পিড, এই স্কিলের প্লেয়ারকে কীভাবে আটকাবো – তাদের সকলের মনের কোনে আজ এই প্রশ্ন। টিভিতে দেখলাম ধারাভাষ্যকার একটা ভালো সমাধান দিলেন – প্রার্থনা কর।

আর যেদিন এমবাপ্পে নিজের স্ট্যান্ডার্ডে অসাধারণ খেলবেন? মানে অফিসের নিছক সাধারণ দিন নয়, যেদিন তিনি ঠিক করবেন আজকে দিনটাকে স্পেশাল করে সেলিব্রেট করা যাক?

সেদিন মহাভারতের সেই কাঠবিড়ালির ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে। সেই কাঠবিড়ালি যে মেক্সিকোর কওয়ারটার ফাইনাল এবং সেমিফাইনাল খেলার জায়গায় গড়াগড়ি দিয়ে নিজের শরীরের অর্ধেকটা সোনালি করে ফেলেছে। অপেক্ষায় আছে আরও একটা ওরকম রাজসূয় যজ্ঞের। সেইদিন তার শরীর পুরোপুরি সোনার হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link