বাংলার ক্রিকেটের প্রথম মহানায়ক

ঘটনাটা ছিল এইরকম। ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে বার্বাডোজে একটি ট্যুর ম্যাচে চার্লি গ্রিফিথের বল মাথায় লেগে গেল প্রথম ইনিংসে ২ রানে অপরাজিত নরি কন্ট্র্যাক্টরের। গুরুতর আহত নরি কন্ট্র্যাক্টরকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যেতে হল হাসপাতালে, যেখানে তাকে নিয়ে যম আর মানুষের প্রবল টানাটানি চলেছিল। রক্ত দরকার হয়ে পড়ল অনেকটাই।

দুটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করছি লেখা।

  • ১. বাংলার কোন টেস্ট ক্রিকেটার বাংলার এক আইকনিক ক্রীড়াসাংবাদিক-কাম-ক্রীড়াসাহিত্যিক-কাম-সাহিত্যিকের উথ্থানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন?

এর উত্তর – পঙ্কজ রায়।

ঘটনাটা ছিল এইরকম। ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে বার্বাডোজে একটি ট্যুর ম্যাচে চার্লি গ্রিফিথের বল মাথায় লেগে গেল। প্রথম ইনিংসে ২ রানে অপরাজিত নরি কন্ট্র্যাক্টরের। গুরুতর আহত নরি কন্ট্র্যাক্টরকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যেতে হল হাসপাতালে, যেখানে তাকে নিয়ে যম আর মানুষের প্রবল টানাটানি চলেছিল। রক্ত দরকার হয়ে পড়ল অনেকটাই।

সব ভারতীয় ক্রিকেটার রক্ত দিলেন। রক্ত দিলেন বার্বাডোজের অধিনায়ক ফ্র্যাঙ্ক ওরেলও। আর আনন্দবাজারের বার্তা সম্পাদক সন্তোষকুমার ঘোষ ৩১ বছরের এক অক্রীড়ক সাংবাদিককে ডেকে বললেন, ‘মতি, তুমি একবার পঙ্কজ রায়ের কাছে যাও। তোমার বাড়ির কাছেই তো। ওর সঙ্গে কথা বলে দেখ কি কি কারণে গ্রিফিথের বল কন্ট্র্যাক্টরের মাথায় লাগতে পারে।’

ওটাই ছিল মতি নন্দীর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। পঙ্কজ রায়ের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা, তারপরে একটি ছোট্ট লেখা সন্তোষকুমার ঘোষের হাতে তুলে দেওয়া  অত:পর তা আনন্দবাজারে প্রকাশিত হওয়া।

আনন্দবাজারের ক্রীড়া বিভাগ সেদিন জানতেও পারেনি যে তাদের বিভাগের বাইরের কেউ এটা লিখে দিয়েছেন।সেই থেকে শুরু। এরপরে ‘কালকেতু’ নামে তাঁর আনন্দবাজারে ‘মাঠ-ময়দানে’ পাতা চালানোটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। তারপরে একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে বাংলা ক্রীড়াসাহিত্য যেন পোষ মেনেছিল মতি নন্দীর কলমহেলনীতে।

ক্রীড়াসাংবাদিকতা ছাড়িয়ে, কখন যেন বাংলা ক্রীড়াসাহিত্য পেরিয়ে, তাঁর লেখা ঢুকে পড়েছিল বাংলা সাহিত্যর সোনালী অন্দরমহলেও। বাংলাতে খেলার লেখা এবং অন্য লেখা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন আলোকবর্তিকা হয়ে থেকে যাবেন প্রণম্য মতি নন্দী।যার একেবারে শুরুর সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন পঙ্কজ রায়।

২. বাংলার কোন টেস্ট ক্রিকেটার প্রথমবারের জন্য ভারতের টেস্ট দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন?

এরও উত্তর – পঙ্কজ রায়।

যদিও এই প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ ক্রিকেটপ্রেমীই কুমারটুলির গাড়ি না ধরে ভুল করে বেহালার অভিমুখী হয়ে যান। ঘটনা হলো ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি মাত্র টেস্টে লর্ডসে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পঙ্কজ রায়। অবশ্য পঙ্কজ রায় তারপরে আর কোনদিন কোন টেস্টে ভারতের অধিনায়ক হননি।

২ নভেম্বর ১৯৫১ থেকে ২ ডিসেম্বর ১৯৬০য়ের মধ্যে ৪৩টি টেস্টে ৭৯ ইনিংস খেলে ২৪৪২ রান করা ছাড়াও একটি ৫২ বছর স্থায়ী ওপেনিং জুটির টেস্ট রেকর্ডের অংশীদার ছিলেন। ৭ জানুয়ারি ১৯৫৬ তারিখে চেন্নাইয়ের (তখন মাদ্রাজ) কিউইদের বিরুদ্ধে ভিনু মানকাদের (২৩১) সঙ্গে পঙ্কজ রায় (১৭৩) প্রথম উইকেটের জুটিতে করেছিলেন ৪১৩ রান, যা ২০০৮ সালে ৪১৫ রান করে ভেঙে দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ-নীল ম্যাকেঞ্জি জুটি, চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।

এই ১৭৩-ই ছিল তাঁর সর্বোচ্চ টেস্ট স্কোর। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওই টেস্ট সিরিজে প্রথম টেস্টে হায়দ্রাবাদে খেলার পরে পঙ্কজ রায় দ্বিতীয় টেস্টে মুম্বাইতে আর তৃতীয় টেস্টে দিল্লীতে ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিলেন, তবে কলকাতায় চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ থাকায় তাঁকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। আর সেই ম্যাচেই তাঁর ‘কামব্যাক’ ঘটেছিল শতরান দিয়ে। তারপর এসেছিল চেন্নাইয়ের সেই দুরন্ত ইনিংস (১৭৩) তথা বিশ্বরেকর্ড।

সেই ইনিংস নিয়ে তাঁর একটাই আক্ষেপ ছিল, দ্বিশতরান না করতে পারা।এরকম শোনা যায় যে ড্রিঙ্কসের সময় তাঁর কাছে একটা উড়ো খবর এসেছিল যে ভারত ইনিংস ঘোষণা করবে, তাই চালিয়ে খেলতে গিয়ে তিনি ১৭৩ রানে আউট হন। তবে এর সত্যতা আজও প্রমাণিত নয়।

পঙ্কজ রায়ের ২৪৪২-এ পাঁচটি শতরান আর নয়টি অর্ধশতরান ছিল। চেন্নাইয়ের কর্পোরেশন স্টেডিয়ামের ওই ১৭৩-ই ছিল তাঁর সর্বোচ্চ টেস্ট রান। একটি উইকেটও পেয়েছিলেন তিনি টেস্টে। একটি আশ্চর্য তথ্য আছে তাঁকে নিয়ে।সারা টেস্ট কেরিয়ারে তিনি মাত্র একটিই ছয় মেরেছিলেন, ৫৯টি চারের সঙ্গে।

৩২.৫৬-এর সাধারণ গড় সত্ত্বেও ওই রেকর্ড এবং বারবার লড়াই করে টিমে থাকাই তাকে অসাধারণ করে রেখেছে। তাঁর ট্রেডমার্ক শট ছিল কভারড্রাইভ ও হুক। হয়ত অনেকেরই আজ আর মনে নেই যে ১৯৮৩ সালের কপিল দেবের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয়ী ভারতের দলের অন্যতম নির্বাচক ছিলেন পঙ্কজ রায়।

প্রবলভাবে সফল একটি সিরিজের পরেই অত্যন্ত শোচনীয় একটি সিরিজ রাখা ছিল তাঁর জন্য, অনেকবার। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৯৫১তে প্রথম সিরিজেই ২টি শতরান ছিল তাঁর। তারপরের বছর ১৯৫২-৭ ইনিংসে ৫টি শূন করেন তিনি, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ‘পেয়ার’-সহ। তারপর পাকিস্তান সিরিজেও তাঁর ব্যাটে মন্দা ছিল।

সগর্বে তার ব্যাট রানের ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে ফিরে আসে ১৯৫৩-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে, জামাইকা টেস্টে ৮৫ ও ১৫০ সহ। দেশের মাটিতে ১৯৫৫-৫৬ মৌসুমের নিউজিল্যান্ড সিরিজে প্রথম টেস্টে হায়দ্রাবাদে একটি শূন্য করার পর দ্বিতীয় টেস্টে কলকাতায় শতরান করেন। তারপরেই সেই চেন্নাইর বিশ্বরেকর্ডের অংশ হন তিনি। ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লর্ডস টেস্টে ভারতকে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন পঙ্কজ রায়, যে কথা আগেই বলেছি। সে ম্যাচে ৮ উইকেটে জিতেছিল ইংল্যান্ড।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। ১৮৫ ম্যাচে ২৮০ ইনিংসে ৪২.৩৮ গড়ে ১১৮৬৮ রান ছিল তাঁর, ৩৩ টি শতরান আর ৫০ টি অর্ধশতরান সহ। তাঁর ভাইপো অম্বর রায় আর ছেলে প্রণব রায়ও ভারতের হয়ে যথাক্রমে ৪টি ও দু’টি টেস্ট খেলেছিলেন।

সুনীল গাভাসকারের টেস্টে প্রবেশের আগে ভারতের অন্যতম সেরা ওপেনার ছিলেন পঙ্কজ রায়। একই ভাবে, সৌরভ গাঙ্গুলির আগে বাংলা ক্রিকেটের অবিসংবাদী মহানায়ক ছিলেন কুমারটুলির পঙ্কজ রায়ই। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০১ তারিখে তাঁর মৃত্যুর পরে তার মৃতদেহে মালা দিতে গিয়ে স্বয়ং সৌরভ গাঙ্গুলি বলেছিলেন এই কথা, ‘The modern generation wants to be like [Sachin]Tendulkar or [Rahul] Dravid, but when we started playing cricket all we knew was about Pankaj-da.’

গত শতাব্দীর শেষার্ধের প্রথমাংশ এবং তারপরেও বাংলা ক্রিকেটে বড় একটা শ্রদ্ধার জায়গা আলাদা করে রাখা ছিল পঙ্কজ রায়ের জন্য।যা কিছুটা হলেও, আজও অম্লান।বাংলা থেকেও ভারতের হয়ে টেস্ট খেলা যায়, এই বিশ্বাসের চারাগাছে প্রথম জল দিয়েছিলেন তিনিই।

১৯২৮ সালের ৩১ মে তারিখে জন্ম হয়েছিল ডানহাতি ওপেনার পঙ্কজ রায়ের। ১৯৭৫ সালে পদ্মশ্রী পান, ২০০০ সালে বাংলার শেরিফ, বাংলা থেকে টেস্ট ক্রিকেট খেলার সফল আদিপুরুষ হলেন পঙ্কজ রায়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...