চাঁদের হাটে স্বাগতম

আর মেসি আসা মানে অনেক কিছু আসা। মেসির অনুরাগীরা, মার্কেটিং ডিল এবং সর্বোপরি ফার্মার্স লিগ বলে পরিচিত লিগ ওয়ানের দিকে আপামর ফুটবল অনুরাগীর নজর আবার ফিরবে। ২০১৭ সালে নেইমারের আসায় কিছুটা বাণিজ্য এসেছিল। কিন্তু চোট আঘাত নেইমারকে কাঙ্খিত সাফল্য পেতে দেয়নি। তবু গত দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পিএসজি সবথেকে কনসিস্টেন্ট দল। বারবার শক্ত গ্রুপ থেকে মাথা উঁচু করেই বেরিয়েছে তারা। এবারে সত্যিই যদি ফাইনালের গাঁট পেরিয়ে ট্রফি না জেতে তাহলে অবাকই হব। তবু, ফুটবলটা তো ড্রয়িং বোর্ডে মাপাঝোকা হলেও আদতে খেলা হয় সবুজ গালিচায়। দ্বিতীয় বেল পড়ে গেছে। আর শুধু সামান্য অপেক্ষা। দেখা হবে লিগ ওয়ানের মাঠে, হয়তো আমাজন প্রাইমে।

হ্যাঁ, আমি নেইমারের ফুটবলের অনুরাগী। হতে পারে ব্রাজিলীয় ফুটবলের অনুরাগী বলে সেই ঐতিহ্যের শেষ নিদর্শনকে যেনতেন প্রকারেন সফল দেখতে চাই। অথবা এও হতে পারে, তাঁর সমস্ত থিয়েট্রিক্সের পরেও যে ঝলক আমরা মাঝেমধ্যেই দেখি তাতেই মজে থাকি। ব্রাজিলীয় হওয়াটা একটা অধিক পাওয়া।

যেমন ধরুন আলিয়েঞ্জ স্টেডিয়ামে বায়ার্নের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় গোলটার সময়। তুষারপাত হচ্ছে, ডি মারিয়ার কর্নার প্রতিহত হয়ে ফিরে এসেছে সেন্টার লাইন থেকে ডানদিকে গজ দশেক দূরে নেয়মারের পায়ে বল। একশর মধ্যে নিরানব্বই ক্ষেত্রে আধুনিক ফুটবলাররা বলটিকে গোলকিপারকে পাস করবে যাতে আবার নতুন করে আক্রমণ শুরু করা যায়, নেয়মার করলেন না। যাস্ট মাথা তুলে দেখে নিলেন তারপর প্রায় ১৫০ ডিগ্রিতে বাঁ পায়ে মাপা পাস বাড়ালেন মার্কুইনহোসকে। গোল করা শুধু সময়ের অপেক্ষা।

অথবা ম্যান ইউয়ের সঙ্গে দশ ডিগ্রি থেকে যে গোলটা করলেন। ডি খেয়ার পাঁ ছুঁড়ে বাঁচানোর অভ্যাস, ফলস্বরূপ দুই পায়ের মধ্যে ফাঁক থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। সেখান দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোল করে দেওয়া।

সে সব থাক। আসলে আমি তো নেয়মারকে নিয়ে লিখতে বসিনি। লিখতে বসেছি লিও মেসির পিএসজি আগমন এবং তার সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে আমার স্বল্পবুদ্ধিতে যা বুঝি তা নিয়ে। হ্যাঁ নেয়মারের জন্যই আমি পিএসজি সমর্থন করি। যেমন অ্যালিসন বেকারের জন্য লিভারপুল পছন্দ হয়।

থিয়াগো সিলভা আমার ক্যাপ্টেন (যদিও চাই না যে তিনি কাতারে যান)। পুরনোপন্থী তো, পুরোপুরি ক্লাবফুটবলে নিমজ্জিত এখনও হতে পারিনি। হলেও সমর্থন প্রশ্নযোগ্য। যাই হোক ২০১৭ থেকে যখন পিএসজির প্রায় ৭৫% খেলা যখন দেখেছি এবং গত মৌসুমের ৯৫% শতাংশ। তখন পচেত্তিনোর কোচিং-এর ধরণ বা পিএসজির খেলার ধরণ নিয়ে কিছুটা বলে ফেলতেই পারি।

প্রথমেই থমাস টুখেল এবং তাঁর চলে যাওয়ায় পোচ। টুখেল উচলে জয়ী কোচ। বেশ বেশ ভালো কোচ। কিন্তু তিনি সিস্টেমের দাস, স্ট্রাকচারের বাঁধা কর্মী। চেলসিতে সফল কারণ প্রতিটি স্থানের জন্য তার সিস্টেম অনুযায়ী প্লেয়ার রয়েছে। কিন্তু পিএসজিতে ম্যান ম্যানেজমেন্টের সমস্যা তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল ওই শিবের মাথায় জল ঢালা কেস। উপরে নেয়মার আর এম্ব্যাপে আছে, তো তাদের পায়ে বল দাও আর যা করার তারাই করবে।

এখন সমস্যা হল নেইমার বা এমবাপ্পে নিচে নেমে ডিফেন্ড করবে না। আর গত বছরের আগের বছর প্যানডেমিকের কারণে সিজন পিছিয়ে গেলে প্রি সিজন করে ফিট করে ফেলার সুযোগ পাননি। উপরন্তু, কিছু প্লেয়ারকে চেয়েও তিনি পাননি। ফলত গত মরসুমে উচলে সেমিফাইনাল খেললেও লিগ ওয়ান হারিয়েছে প্যারিস এবং সব খেলা দানা বাঁধছিল না।

পোচ এসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন। এক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসাবে ভেরাত্তিকে ছয় নম্বরে খেলানো হচ্ছিল, তিনি আটে নিয়ে এলেন। এমনিতে বল কাড়া এবং ডিসট্রিবিউশনের ব্যাপারে ভেরাত্তি এক নম্বর। কিন্তু মাঝে মাঝে ডিফেন্সিভ মিডিফিল্ড পজিশনে মাথা গরম করে এমন জায়গায় ফাউল করে ফেলেন যেখান থেকে বিপক্ষ সুবিধা পেয়ে যায়। আটে সেই সমস্যা কম।

ছয়ে নিয়ে গেলেন পারাদেসকে। পারাদেসের ডিস্ট্রিবিউশন খুব ভালো। কিন্তু অফ দ্য বল অতটা নয়।

যাই হোক এমবাপ্পের অনবদ্য ফর্ম এবং সুস্থ নেয়মারকে যেটুকু পাওয়া যায় তাই দিয়ে বার্সা ও বায়ার্নকে অ্যাওয়ে ম্যাচে হারিয়ে সেমি ফাইনালে যাওয়া যায়, কিন্তু সেমি ফাইনালে আহত এমব্যাপের নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া এবং নাভাসের ডিস্ট্রিবিউশনের সমস্যায় দুটো ম্যাচই হারে। ভালো শুরু করেও।

এরই ভিত্তিতে এবারের ট্রান্সফার জানালার সদব্যবহার। প্রথমেই উইনল্ডাম। বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার হিসাবে ডাচ অধিনায়ক ক্লপের খুব পছন্দের ছিলেন। এবারে লিভারপুল আর অর্থ বা সময় বাড়াতে চায়নি। বার্সিলোনার হাত থেকে শেষ মুহূর্তে ছিনিয়ে নেয় পিএসজি। বলা হচ্ছে যদিও টাকাটাই মূল। তবুও উইনল্ডাম বলছেন পোচ ওঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে পিএসজির প্রোজেক্টের বিষয়ে উইনল্ডামকে সম্মত করেছেন। ভেরাত্তি, উইনল্ডাম এবং পারাদেস এবারের পিভট হতে যাচ্ছেন। চোট প্রবণ ভেরাত্তি মাঝেমধ্যে না থাকলেও বাকি দুজন কাজ চালিয়ে নেবেন।

এরপরের এই মরসুমের সম্ভবত সেরা রিক্রুট আচরাফ হাকিমি। হাকিমি রিয়েলের খেলোয়াড়। কিন্তু ডানদিকে কার্বাহালকে খেলাতে হাকিমিকে লোনে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড পাঠায় রিয়েল। যথেষ্ট ভালো পারফরম্যান্স, ডিফেন্সিভ কোয়ালিটি একটু কম হলেও আক্রমণে গতি আর ভিশনের মিশেলে দুর্ধর্ষ। গতবার ফ্লোরেঞ্জিকে দিয়ে পুরো কাজটা করা যায়নি। সেখানে হাকিমি এখন ওই পজিশনে বিশ্বের সেরা। টিএএ-র থেকেও গত বছর হাকিমি ইন্টারে অনেক বেশি সফল। তার উপর আরেক পাওনা, গোলটা চেনেন হাকিমি। প্রথম ম্যাচেই গোল করে তার প্রমাণ দিয়েই দিয়েছেন।

সার্জিও র‍ামোস। ব্যক্তিগতভাবে আমি হয়তো ভারানকে পছন্দ করতাম। ভারানের বয়স কম, অভিজ্ঞতাও রয়েছে। কিন্তু র‍্যামোসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য। গত বছরের চোট আঘাত থেকে বেরোতে পারলে, র‍্যামোসের লীডারশিপ ক্ষমতা মার্কুইনহোস এবং কিম্পেম্বের জন্য ভালোই হবে। আর র‍্যামোস খেলতে পারলে তো কথাই নেই।

জিয়ানলুইজি ডোনারাম্মা। পিএসজির তেকাঠির নিচে অন্যতম নির্ভরযোগ্য কেলর নাভাস রয়েছেন। কিন্তু নাভাসের বয়স হয়েছে, এবং হাই প্রেসিং-এ ডিস্ট্রিবিউশনের সময় নাভাসের সমস্যা আছে। গত উচলে সেমিফাইনালে হোম ম্যাচে তা প্রকটও হয়েছে। যদিও শট স্টপার হিসাবে তিনি দুর্দান্ত। ডোনারাম্মার অ্যালিসন বা এডারসনের মতো ডিস্ট্রিবিউশনারি ভিশন বা ন্যুয়ারের মতো স্যুইপার কোয়ালিটি না থাকলেও, চাপের মুখে ঠান্ডা মাথায় পাসিং করতে সক্ষম এবং অনেকটাই বয়সে কম এবং এবং এবং, কোনও ট্রান্সফার ফি ছাড়াই পাওয়া গেছে ওঁকে।

এর পরের যে গল্প শোনা যাচ্ছিল সেটা পল পগবাকে নিয়ে। এমব্যাপেকে ধরে রাখার জন্য নাকি পোগবাকে ভাবা হচ্ছে। এই মুভটায় আমার সমস্যা হচ্ছিল। পোগবা যে কাজটা করবে, সেটা তো নেয়মারই করে দিচ্ছেন। এবং পোগবারও ডিফেন্সিভ কোয়ালিটি খারাপ। বরং পোগবার জন্য যে খেলোয়াড়টির উপর সেভাবে নজর দিচ্ছিল না পিএসজি তার নাম কামাভিঙ্গা। রেনেতে খেলেন। মাত্র উনিশেই ফ্রান্সের হয়ে খেলে ফেলেছেন এবং অলরাউন্ডার হিসাবে তিনি ভবিষ্যতের তারকা। মেসি আসায় পোগবার মিসঅ্যাডভেঞ্চার বন্ধ হয়েছে এবং এক নতুন গ্যালাক্টিক দলের জন্ম হয়েছে।

মেসিকে নিয়ে বেশি বক্তব্য নেই, দরকারও নেই। উনি কী করতে পারেন আর কী সম্ভাবনা আছে সে নিয়ে আমার থেকে ভালো আপনারাই জানেন। তবু যাঁরা আশঙ্কা করছেন যে মাথাভারী দল হয়েছে, ২০০২-২০০৬ সময়কার রিয়ালের মত অবস্থা না হয়, তাঁদের জন্য কয়েকটি কথা।

একমাত্র লেফট ব্যাক পজিসনটা ছাড়া পিএসজি দাঁড়িয়ে গেছে। রিয়ালের সেই সময় সবথেকে বড় ভুল হয়েছিল, দলের প্রাণভোমরা ম্যাকলেলেকে বেচে দিয়ে বেকহ্যামকে কেনা। ফলস্বরূপ গোল করেও গোল বেশি খেয়ে কিছুই করে উঠতে পারেনি।

পিএসজি কিন্তু গত দু বছরেই মাঝমাঠটাকে গুছিয়ে নিয়েছে। বার্নেটের চোটের জন্য বাঁ দিকটা নিয়ে সমস্যা ছিল, সেটা বার্নেট ফিরে এলে কিছুটা মিটবে। আর তদুপরি যদি থিও হার্নান্ডেজকে মিলান থেকে বাগিয়ে আনা সম্ভব।

ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসাবে ড্যানিলো খুব দরের না আর অ্যান্ডার হেরেরারও বয়স হচ্ছে, চোট প্রবণতা আছে। সেখানে কামাভিঙ্গা চলে এলে তো মাসাল্লাহ।

তাহলে ফর্মেশন? পোচ খেলতে পছন্দ করেন দুজন আপফ্রন্টে এবং দুজন পিভট নাম্বার ৮-১০। সেটা হলে উপরে ডানদিকে মেসি বাঁদিকে কিলিয়ান আর নিচে বাঁদিকে নেয় আর ডানদিকে ডি মারিয়া। মিডফিল্ডের পিভটের জায়গাটায় পারাদেস/ গায়া/হেরেরা এবং উইনল্ডাম/ ভেরাত্তি/ ড্রেক্সলার। ডিফেন্সে র‍ামোস ডানদিকে খেললে বাঁ দিকে মার্কুইনহোস এবং সেক্ষেত্রে প্রেসনেল কিম্পেম্বেকে বসতে হবে। দুদিকে হাকিমি এবং বার্নেট।

গতিশীল দলের ক্ষেত্রে তিন ব্যাক সিস্টেমে মাঝে পিভট হিসাবে মার্কুইনহোসকে রেখে ডানদিকে র‍্যামোস এবং বাঁদিকে বাঁ পায়ী কিম্পেম্বে। রাইট উইং হাফে হাকিমি এবং লেফট উইং হাফে বার্নেট। মাঝে উইনল্ডাম এবং ভেরাত্তি উপরে মাঝখানটা ১০ নম্বরে নেয়মার। বাঁদিক বা ডানদিকের ১১ নম্বরে এমব্যাপে এবং ফলস নাইনে মেসি।

অথবা যদি অল আউট অ্যাটাকে যান তাহলে ন নম্বরে ইকার্ডিকে নামিয়ে মেসি নেয়মার মাঝখানে রেখে দুই উইং-এ এমবাপ্পে ও দি মারিয়া আর মাঝে উইনল্ডাম ও ভেরাত্তি এবং দুই উইং-এ বার্নেট ও হাকিমি। আর সঙ্গে একই কোয়ালিটির না হলে ব্যাকআপ হিসাবে আব্দাউ দিয়ালো এবং লেভিন কুরজাওয়া রইলেনই। সব মিলিয়ে একটা এক্সাইটিং সিজনের জন্য অপেক্ষা করছি।

মেসির কাছে নতুন অবস্থায় মানিয়ে নেওয়া একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু পোচ আছেন, দিমারিয়া আছেন, ভেরাত্তি আছেন আর সর্বোপরি আছেন নেয়মার। সঙ্গে এমব্যাপের মতো একটা টর্পেডো। ডিফেন্সটাকেও মনমতো সাজিয়ে নিতে পারছেন পোচ। আর ট্রান্সফার উইন্ডো শেষ হতে এখনও কুড়ি দিন। তাতে কী হয় কেউ জানে না। তবে এটা ঘটনা হাকিমি ছাড়া কোনও রকম ট্রান্সফার ফি না দিয়ে ডোনারাম্মা, উইনল্ডাম, র‍্যামোস এবং সর্বোপরি মেসিকে তুলে নেওয়া গেলে সেটাকে সফল বলতেই হয়। কামাভিঙ্গা এবং হার্নান্ডেজ নিয়ে এখনই কিছু বলার সময় আসেনি। কিন্তু কিছুই বলা যায় না।

আর মেসি আসা মানে অনেক কিছু আসা। মেসির অনুরাগীরা, মার্কেটিং ডিল এবং সর্বোপরি ফার্মার্স লিগ বলে পরিচিত লিগ ওয়ানের দিকে আপামর ফুটবল অনুরাগীর নজর আবার ফিরবে। ২০১৭ সালে নেইমারের আসায় কিছুটা বাণিজ্য এসেছিল। কিন্তু চোট আঘাত নেইমারকে কাঙ্খিত সাফল্য পেতে দেয়নি। তবু গত দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পিএসজি সবথেকে কনসিস্টেন্ট দল। বারবার শক্ত গ্রুপ থেকে মাথা উঁচু করেই বেরিয়েছে তারা। এবারে সত্যিই যদি ফাইনালের গাঁট পেরিয়ে ট্রফি না জেতে তাহলে অবাকই হব। তবু, ফুটবলটা তো ড্রয়িং বোর্ডে মাপাঝোকা হলেও আদতে খেলা হয় সবুজ গালিচায়। দ্বিতীয় বেল পড়ে গেছে। আর শুধু সামান্য অপেক্ষা। দেখা হবে লিগ ওয়ানের মাঠে, হয়তো আমাজন প্রাইমে।

কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...