রাহানের পুনরুত্থান অধ্যায়

গত বছরটা ব্যাট হাতে মোটেই ভালো কাটেনি আজিঙ্কা রাহানের। টেস্টে সহঅধিনায়কত্ব হারানোর পাশাপাশি বাদই পড়েছিলেন জাতীয় দল থেকে। কিন্তু এবারের আইপিএলে যেন পুর্নজন্ম ঘটেছে রাহানের, বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন এই তারকা। 

গত বছরটা ব্যাট হাতে মোটেই ভালো কাটেনি আজিঙ্কা রাহানের। টেস্টে সহঅধিনায়কত্ব হারানোর পাশাপাশি বাদই পড়েছিলেন জাতীয় দল থেকে। কিন্তু এবারের আইপিএলে যেন পুর্নজন্ম ঘটেছে রাহানের, বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন এই তারকা। 

রাহানেকে কখনোই টি-টোয়েন্টিতে ভরসাযোগ্য ক্রিকেটার ভাবা হয়নি। বরং তাঁর শান্ত পরিশীলিত ব্যাটিংটা টেস্টেই মানানসই এমনটা বোধহয় খোদ রাহানেও অস্বীকার করতেন না এবারের আইপিএল শুরুর আগে। ভারতের হয়ে সর্বশেষ ২০১৬ সালে টি- টোয়েন্টিতে মাঠে নেমেছেন। পরিসংখ্যানটাও বড্ড মলিন, ২০ ম্যাচে ২০.৮৩ গড় এবং ১১৩ স্ট্রাইকরেটে সংগ্রহ করেছেন মাত্র ৩৭৫ রান।  

আইপিএলেও রেকর্ডটা তেমন সুবিধার নয়। গত মৌসুমে ইনজুরিতে ছিটকে যাবার আগে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে সাত ম্যাচে ১০৩ স্ট্রাইকরেটে করেছিলেন ১৩৩ রান। আধুনিক যুগের মারকুটে সব ব্যাটসম্যানদের ভীড়ে রাহানের স্ট্রাইকরেটটা তাই বড্ড বেমানান। একমাত্র ভালো মৌসুমের স্মৃতিটাও ফিকে হয়ে যেতে বসেছে। ২০১৯ মৌসুমে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে ১৩ ইনিংসে করেছিলেন ৩৯৩ রান। 

টেস্ট দল থেকে বাদ পড়ার পর ঘরোয়া ক্রিকেটেও সাদা বলে বলার মতো কিছু করতে পারেননি। বরং সৈয়দ মুস্তাক আলী ট্রফিতেও কাটিয়েছেন সাদামাটা এক মৌসুম। ফলে এবারের আইপিএল নিলামে তাঁকে দলে ভেড়াবে কোনো দল এমনটা ভাবা ছিল অনেকটা আকাশ কুসুম কল্পনা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাঁকে ৫০ লাখ রুপিতে তাঁকে দলে ভেড়ায় চেন্নাই সুপার কিংস।

তবে তাঁর মতো অভিজ্ঞ কাউকে দলে ভেড়াতে কোনো দল আগ্রহ না দেখানোতে খানিকটা অবাকই হয়েছে মুম্বাইয়ের কোচ অমল মুজুমদার। তিনি বলেন, ‘যদিও আমি জানি নিলামের পরিবেশ আলাদা। কিন্তু যখন একজন অভিজ্ঞ টেস্ট খেলোয়াড় নিলামে উঠে, সেটা ভারতীয় কিংবা বিদেশি যাই হোক, দলগুলোর উচিত আরেকটু ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া।’

আইপিএলে চেন্নাইয়ের শুরুর ম্যাচগুলোতে একাদশে ছিলেন না রাহানে। কিন্তু বেন স্টোকস এবং মঈন আলীর ইনজুরির সুবাদে মুম্বাইয়ের বিপক্ষে ম্যাচে অপ্রত্যাশিতভাবে সুযোগ পেয়ে যান রাহানে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিন নম্বরে নেমে সাত চার এবং তিন ছক্কায় ২৭ বলে ৬১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন এই তারকা। মাত্র ১৯ বলে ফিফটি হাঁকিয়ে বনে যান চেন্নাইয়ের ইতিহাসে যৌথভাবে দ্বিতীয় দ্রুততম ফিফটির মালিক। পরের ম্যাচগুলোতে বড় ইনিংস খেলতে না পারলেও ঝড়ো ব্যাটিং করে উড়ন্ত সূচনা এনে দিয়েছেন দলকে। 

কলকাতার বিপক্ষে তো রীতিমতো ছাড়িয়ে যান নিজের পূর্বের সব রেকর্ডকে, মাত্র ২৯ বলে খেলেন ৭১ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। সেদিন যেন ভিন্ন এক রাহানেকেই দেখেছিল গোটা বিশ্ব। কখনো উমেশ যাদবকে পুল করেছেন, আবার কখনো স্কুপে সীমানার বাইরে আছড়ে ফেলছিলেন আন্দ্রে রাসেলকে। 

তবে রাহানের এমন প্রত্যাবর্তনে মোটেই অবাক হননি ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর কোচ অমল মুজুমদার। তিনি বলেন, ‘এটা আমার কাছে চমক হয়ে আসেনি। সত্যি বলতে ২৯ বলে ৭১ রানের ইনিংস আমি আশা করিনি। কিন্তু আমি জানতাম এবারের মৌসুমে সে আলো ছড়াবেই। গোটা মৌসুমজুড়েই সেই দুর্দান্ত ব্যাটিং করছে।’

মুম্বাইয়ের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে অবশ্য অধিনায়ক হিসেবে সফল ছিলেন রাহানে। রঞ্জিতে ফাইনালে তোলার পাশাপাশি মুস্তাক আলী ট্রফিতে শিরোপা জিতিয়েছেন দলকে। এছাড়া লাল বলের ক্রিকেটে ছিলেন দলের পক্ষে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক।

অমল বলেন, ‘দলের অধিনায়ক হিসেবে সে সব সময় সামনে থেকে পারফর্ম করেছে। সে অনুশীলনে এখনো ১৯ বছর বয়সী তরুণের মতোই মনোযোগী। পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে সে জানে তাঁকে কি করতে হবে। আইপিএলে সেটারই প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর টেম্পারমেন্ট নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই, কেবল ছক্কা হাঁকানোর শটগুলো নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। বিশেষ করে মিড উইকেটের উপর দিয়ে হাঁকানো শটগুলো।’

২০১৬ এবং ২০১৭ আইপিএল মৌসুমে রাজস্থান এবং চেন্নাই নিষিদ্ধ থাকাকালীন সময়ে রাজিং পুনে সুপারজায়ান্টসের হয়ে খেলেছিলেন রাহানে এবং ধোনি। সেই সময়টাতে ব্যাট হাতে নিয়মিত রান করেছেন রাহানে, দুই মৌসুমে ৩০ ম্যাচে ১২২ স্ট্রাইকরেটে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৮৬২ রান। ছয় বছর পেড়িয়ে আবারো ধোনির দলে নাম লিখিয়েই যেন পুরনো ছন্দ ফিরে পেয়েছেন রাহানে। এবারের মৌসুমে কমপক্ষে ১৫০ রান করাদের মাঝে তাঁর ১৮৯ স্ট্রাইকরেটই সর্বোচ্চ। 

২০১২ সালে প্রথমবারের মতো এক ওভারে টানা ছয়টি চার মেরেছিলেন রাহানে, ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে খেলেছিলেন ৬০ বলে ১০৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। সেই সময়টাতে রাহানে বাউন্ডারির জন্য নির্ভর করতেন নিখাদ টাইমিং এবং প্লেসমেন্টের উপর। এগারো বছর বাদের রাহানে যেন আরো ভয়ংকর, এই মৌসুমে ইতোমধ্যেই ১১টি ছক্কা হাঁকিয়েছেন এই তারকা। 

তবে কি ধোনির অধিনায়কত্বের জাদুতেই বদলে যান ক্রিকেটাররা? অমল বলেন, ‘ধোনির সবচেয়ে বড় গুণ হলো সে দলের সবাইকে নিজের রোলটা বুঝিয়ে দেয়। দল থেকে নিশ্চয়তা দেয়া হয় এবং প্রথম ম্যাচ থেকেই নিজের কম্বিনেশন ভেবে রাখে ধোনি। আইপিএলে বহু অধিনায়ক, টিম ম্যানেজমেন্টকে দেখেছি টুর্নামেন্টের মাঝপথেও সেরা কম্বিনেশন খুঁজে না পেতে। ধোনি একদম নিলাম থেকেই সবকিছু ভেবে রাখে।’

তিনি বলেন, ‘আপনি একবার ওর ইতিহাস ঘেটে দেখুন, বহু ক্রিকেটারকে সে আন্তর্জাতিক তারকা বানিয়েছে; রবিচন্দ্রন অশ্বিন, দীপক চাহার, শার্দুল ঠাকুর। মানপ্রীত গোনি জাতীয় দলে খেলেছেন, মোহিত শর্মা জাতীয় দলে খেলেছেন। আরো অনেক উদারহরণ আছে। সুতরাং আপনি যদি একবার ধোনির একাদশে জায়গা পান, তবে ধরে নেয়া যায় অবিশ্বাস্য রকমের বাজে মৌসুম না কাটালে  আপনি বাদ পড়ছেন না। এই নিশ্চয়তাটা খুব দরকার ক্রিকেটারদের। রাহানে একদম নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন দলটার সাথে।’

আইপিএলে ফর্মে ফেরার সাথে সাথেই যেন ভাগ্য ফিরতে শুরু করেছে রাহানের। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের স্কোয়াডে পুনরায় জায়গা করে নিয়েছেন এই তারকা। তাঁর এই দলে ফেরার সাথে হয়তো আইপিএলের মারকুটে ব্যাটিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাঁর এই রানে ফেরা, নিজেকে উজাড় করে দেয়ার মানসিকতা সাহায্য করবে জাতীয় দলের হয়েও। 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...