সাকিব-মিরাজ, বিপরীত চরিত্রে সমান বিপজ্জনক

২০১১ থেকে ২০২৩ বিশ্বকাপ, এক যুগের সময়কালে অনেক কিছু বদলে গেলেও বদলায়নি অলরাউন্ডারদের সিংহাসনে সাকিবের একচ্ছত্র আধিপত্য। ৩৬ বছর বয়সী এ অলরাউন্ডার এখনো রয়ে গিয়েছেন চেনা ছন্দে। তবে বাংলাদেশের এবারের দলটাতে অলরাউন্ডার সাকিবের সঙ্গী যেন আরেক অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ।

অলরাউন্ডারদের ভুবনে সাকিবের শ্রেষ্ঠত্ব বহু বছর আগে থেকেই। এবারের বিশ্বকাপ দিয়ে ক্যারিয়ারে পঞ্চম বারের মতো বৈশ্বিক এ আসরে অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে ২০০৭ বিশ্বকাপ বাদ দিলে পরের ৪ বিশ্বকাপই সাকিব শুরু করেছেন অলরাউন্ডারদের র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষে থেকে। অর্থাৎ ২০১১ থেকে ২০২৩ বিশ্বকাপ, এক যুগের সময়কালে অনেক কিছু বদলে গেলেও বদলায়নি অলরাউন্ডারদের সিংহাসনে সাকিবের একচ্ছত্র আধিপত্য।

সাকিবের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ব্যাট হাতে ৩৭.৫৫ গড়ে ৭৩৯৮ রান। আর বল হাতে ২৯.১৩ গড়ে ৩১১ উইকেট। ৭০০০ রানের পাশাপাশি তিন শতাধিক উইকেটের কীর্তি অবশ্য সাকিব বাদে আরো দু’জন ক্রিকেটারের আছে। একজন সনাথ জয়াসুরিয়া। আর অন্যজন হলেন শহীদ আফ্রিদি।

কিন্তু এই দুই অলরাউন্ডারের কারোর ব্যাটিং গড়ই ৩৩ এর বেশি কিংবা বোলিং গড় ৩৪ এর নিচে নয়। ৭০০০ রান আর ৩০০ উইকেটের কীর্তিতে সাকিব এখানেই বাকিদের চেয়ে এগিয়ে। যদিও ব্যাট হাতে ৮২ স্ট্রাইকরেট নিয়ে অবশ্য বাকি দু’জনের চেয়ে সাকিব পিছিয়ে থাকছেন। কিন্তু বোলিং ইকোনমিতে আবার সাকিবের আধিপত্য। জয়াসুরিয়ার বোলিং ইকোনমি ৪.৭৯, আফ্রিদির সেখানে ৪.৬৩। আর সাকিবের বোলিং ইকোনমি ৪.৪৩।

বিশ্বকাপের মঞ্চে আবার সাকিবের ধারের কাছেও কেউ নেই। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের ইতিহাসে শীর্ষ ১০ রান সংগ্রাহক ব্যাটার কিংবা বোলার- দুই তালিকাতেই রয়েছেন সাকিব। ব্যাট হাতে ১১৬০ রানের পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ৩৭ টি উইকেট। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ১০০০+ রানের পাশাপাশি ৩০ উইকেটের কীর্তিও সাকিবের আগে কারো ছিল না।

শুধু তাই নয়, শেষ বিশ্বকাপে ৬০৬ রানের সাথে ১১ উইকেট নিয়েও রেকর্ড বই নতুন কীর্তিতে নাম লিখিয়েছিলেন সাকিব। কারণ তখন পর্যন্ত ৬০০ রান, ১০ উইকেটের কীর্তি তো দূরে থাক, ৫০০ রানের সাথে ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তিরও স্বাক্ষী হয়নি বিশ্ব ক্রিকেট। সাকিব সেখানে ২০১৯ বিশ্বকাপের এক আসরেই সেই অভাবনীয় কীর্তি গড়েছিলেন।

তবে এবারের বিশ্বকাপে শুধু সাকিব নয়, সাকিবের সাথে অলরাউন্ডারদের ভুবনে আলো ছড়ানোর পথে রয়েছেন আরেক বাংলাদেশি। তিনি মেহেদি হাসান মিরাজ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৩ উইকেটের পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৫৭ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা হয়েছেন এ অলরাউন্ডার। ঠিক যেন সাকিবের প্রতিচ্ছবি দেখা গিয়েছে মিরাজের অলরাউন্ডিং নৈপুণ্যে।

মূলত উপরের দিকে ব্যাটিংয়ে সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই জ্বলে উঠছেন মিরাজ। ২০২২ সালের পর থেকে যদি পরিসংখ্যানে একটু নজর দেওয়া যায়, তাহলে বেরিয়ে আসবে মিরাজের অলরাউন্ডার স্বত্ত্বার আসল চিত্র। এ সময়কালে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৩৯ উইকেট পেয়েছেন তিনি। আবার দলের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ের দিক দিয়ে তিন নম্বরে অবস্থান তাঁর। এ সময়কালে ৩৭.৬১ গড়ে ৬৭৭ রান করেছেন তিনি।

এবারের বিশ্বকাপের মূল পর্ব নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেক দলকেই পেরিয়ে আসতে হয়েছে ওয়ানডে সুপার লিগ। ওয়ানডে সুপার লিগে বাংলাদেশের তৃতীয় হওয়ার যাত্রাতেও সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন মিরাজ। বাংলাদেশের মধ্যে সুপার লিগে সর্বোচ্চ ৪ বার ম্যাচ সেরার পুরস্কার যে উঠেছে তাঁর হাতে। যার শুরুটা হয়েছিল গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে, আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচ দিয়ে।

সে ম্যাচে খাদের কিনারায় থাকা বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছিলেন আফিফ আর মিরাজ। তাদের জুটিতেই প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচ জিতে ফিরেছিল বাংলাদেশ। ৮১ রান করে অপরাজিত থাকা মিরাজকেই সে দিন ম্যাচ সেরার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই ৩ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছিলেন মিরাজ।

তবে ক্যারিয়ারের সেরা সিরিজটি বোধহয় কাটিয়েছিলেন গত বছরের শেষ দিকে, ভারতের বিপক্ষে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে। ঐ সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ জিতেই সিরিজ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। আর দুটি ম্যাচেই ম্যাচসেরা হন মিরাজ। সিরিজের প্রথম ম্যাচটিতে বলতে গেলে তাঁর অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ের উপরে ভর করেই জিতেছিল বাংলাদেশ। ৩৮ রান করে ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন। তবে ম্যাচ পরিস্থিতিতে ঐ ৩৮ রানের গুরুত্ব ছাপিয়ে গিয়েছিল সবার অবদানকে।

ভারতের বিপক্ষে এর পরের ম্যাচটাও ছিল একরকম মিরাজময়। ব্যাট হাতে সেঞ্চুরি করেছিলেন। তারপর বল হাতে নিয়েছিলেন দুটি উইকেট। এমন ম্যাচজয়ী অলরাউন্ডিং নৈপুণ্যের পর অনুমিতভাবেই ম্যাচসেরার পুরস্কার গিয়েছিল মিরাজের হাতে।

মিরাজ অবশ্য বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই ছিলেন পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার। ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বল হাতে ১২ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ৬০.৫০ গড়ে ২৪২ রান করেছিলেন মিরাজ। আর সেবার বাংলাদেশ যুবারা তৃতীয় হয়ে আসর শেষ করলেও টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার উঠেছিল মিরাজের হাতে।

জাতীয় দলে আসার পর থেকে মিরাজ পরিচয় একরম স্পিনারই হতে বসেছিল। ২০২১ পর্যন্তও লোয়ার অর্ডার ব্যাটার হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হতো। শেষ দিকে ব্যাটিংয়ে নেমে তাই বলার মতোও কিছু করতে পারেননি। ৩২ ম্যাচে ১৫.২১ গড়ে মাত্র ৪২৬ রান। অবশ্য এমন বিবর্ণ পরিসংখ্যানকে কাঠগড়ায় তোলারও কোনো কারণ নেই। সেই ৩২ ম্যাচের মাত্র ৬ টি ইনিংসে যে তিন ব্যাটিং অর্ডারের শীর্ষ ৬-এ খেলতে পেরেছিলেন।

তবে ২০২২ সাল থেকেই বদলে যেতে থাকে মিরাজের ব্যাটিংয়ের চিত্র। তখনও অবশ্য শেষের দিকেই ব্যাট করতেন। তবে শুরুতে দ্রুত উইকেট পড়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের ঘোর বিপদের দিনেই তাঁর ব্যাট হেসেছে। আর তাতেই ফুটে উঠেছে তাঁর ব্যাটিং সক্ষমতা। একই সাথে, টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থাও অর্জন করেছেন ঐ বছরেই।

মিরাজ আস্থার প্রতিদান দিয়ে আসছেন এরপর থেকেই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওপেনিংয়ে সুযোগ পেয়েই করেছিলেন সেঞ্চুরি। এরপর বিশ্বকাপে সেই একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তিনে নেমে করলেন ফিফটি। এর আগে অবশ্য প্রস্তুতি ম্যাচের দুটিতে ফিফটি করে টপ অর্ডারে নিজের অবস্থান শক্ত করেছিলেন মিরাজ।

মিরাজের ব্যাটিং দ্যুতিতে যে বোলিংটা আড়ালে চলে যায়নি তার প্রমাণ মিলেছে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই। মোদ্দাকথা, অলরাউন্ডার মিরাজ ছুটছেন নিজস্ব গতিতেই। যে গতিতে এতকাল ছুটেছিলেন সাকিব আল হাসান। মিরাজ হয়তো দিনশেষে ‘মিরাজ’ই হতে চাইবেন।

সাকিবের শ্রেষ্ঠত্বের পাশে হয়তো একটা অধ্যায়ে নিজেকে লিখবেন। তবে একই দলে সাকিব আর মিরাজের মতো অলরাউন্ডার পাওয়াটা যেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম এক প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তিযোগে এবার যদি বিশ্বজয় হয়, তবে মন্দ কী! প্রত্যাশার অসীম সীমানায় চোখ রাখার এই তো সময়।

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...