‘ভালো’তেল্লি হতে পারেননি বালোতেল্লি

তিনি যে ঐশ্বরিক প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শৈশবের অনেক চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে ঠাঁই হয়েছিল ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের মঞ্চে। কিংবা ইতালির জাতীয়তা দলে। অমিত প্রতিভা যেমন ছিল, তেমনি ছিলেন খামখেয়ালি, তার চেয়েও বেশি ছিলেন উগ্র। আচরণ আর শৃঙ্খলাজনিত সমস্যায় সময়ের অনেক আগেই তিনি ছিটকে গিয়েছেন মূল স্রোত থেকে।

নিজের সময়ে সেরাদের কাতারে থাকা মারিও বালোতেল্লি তাই বিশ্বের বড় বড় ক্লাব থেকে বিদায় নিয়ে এখন খেলে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন লিগের নিচের সারির দলগুলোতে। একটা সময় লিওনেল মেসি যার চেয়ে সামান্য একটু এগিয়ে ছিলেন, সেই বালেতেল্লি কেন ক্রমেই দূরত্বটা এত এত আলোকবর্ষ সমান করে ফেললেন!

মারিও ছিলেন সুপার মারিও। কিন্তু, আচরণগত সমস্যাই জীবনটা তাঁর এলোমেলো করে দিয়েছে।

সব সমস্যার শুরু একদম গোড়া থেকেই। ইতালিয়ান ফুটবলে বেশ নিয়মিতই বর্ণ বৈষম্যে নিয়ে অনেক অভিযোগ আসে। এর ব্যতিক্রম ছিলেন না বালোতেল্লি। ইতালিতে খেলাকালীন সময়ে তিনিও বেশ কয়েকবার বর্ণ বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আর তিনি পেনিনসুলাতেও তিনি প্রচুর বর্ণ বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। যখন খুব কম বয়সে কেউ এই রকম বৈষম্যের শিকার হয়, তখন তাঁর মানসিকতা বেশ শক্ত হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। এই বিষয়টাই তাঁর উগ্র আচরণে ফুঁটে উঠেছে।

এছাড়াও বালোতেল্লির মধ্যে রয়েছে প্রচুর দাম্ভিকতা। বালোতেল্লি ভাবেন মানব জাতির জন্য তিনি ঈশ্বরের উপহারস্বরুপ। যখন তিনি গোল্ডেন বয় পুরষ্কার নেন, তখন বালোতেল্লি জানান, তিনি জানেন না কে এই জ্যাক উইলশেয়ার!

এছাড়া আরো বলেন আর যেসব তরুণ তারকা এই পুরষ্কার জিতেছে তাদের মধ্যে একমাত্র লিওনেল মেসি তাঁর থেকে কিছুটা ভালো। এই দাম্ভিকতা থেকেই তাঁর মধ্যে অলসতার জন্ম নেয়। বালোতেল্লি বিশ্বাস করেন যে, তাকে চেষ্টাও করতে হবে না এবং তিনি গোল করতে পারবেন। তাঁর এই উগ্র আচরণের জন্য বিশ্বের কোনো ফুটবল সমর্থকই তাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখতো না।

এছাড়াও তাঁর বড় হওয়া নিয়েও বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন তিনি। বালোতেল্লি বরাবরই বলেছেন, তাঁকে দত্তক নেওয়া পরিবারকে তিনি ভালোবাসেন কিন্তু তাঁর আসল বাবা-মাকে তিনি ঘৃণা করেন। কারো পক্ষে তাঁর নিজের বাবা মাকে ঘৃণা করা সম্ভব নয়, আর কোনো শিশু যদি এটি করে থাকে তবে সেটা কখনোই ভালো ফলাফল বয়ে নিয়ে আসে না।

ছোট বেলায় বালোতেল্লি তাঁর দত্তক নেয়া মার হাত ধরে ঘুমিয়ে থাকতেন। কারণ তিনি বেশ ভয় পেতেন। এই ভয়টি হয়েছিলো কারণ তিনি জানতেন কে তাঁর আসল বাবা মা কিংবা কোথা থেকে তিনি এসেছেন এটা নিশ্চিত হতে না পারার কারণে। তাঁর আফ্রিকান মা-বাবার উপর ঘৃণা তাঁর জীবনে প্রভাব ফেলেছে।

মারিও বালোতেল্লির আরেকটি সমস্যা ছিলো তাঁর এজেন্ট নিয়ে। তাঁর এজেন্ট ছিলেন মিনো রাইওলা। মিনো রাইওলা বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টির কারিগর ছিলেন। তিনি আসলে কোনো ২০ বছর বয়সী ফুটবলারের জন্য রোল মডেল হবার যোগ্য ছিলেন না। কিংবা কখনো কোনো ফুটবলারকে সামলানোর মত যোগ্য ছিলেন না। এজেন্টের এই সমস্যা বালোতেল্লির ক্যারিয়ারে অনেক বড় একটি প্রভাব তৈরি করেছে।

সবশেষে বালোতেল্লির জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে বিভিন্ন অজুহাত। সবাই তাকে বিভিন্ন খারাপ কাজ করার পরও তাকে বাচিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। সবাই বলেছে তরুণ বয়সে যে কেউ এই রকম কাজ করতে পারে। এইসব কারণে তাকে বিভিন্ন দিক থেকে রক্ষা করা চেষ্টা করা হয়েছে। বালোতেল্লির ক্যারিয়ারের মূল সমস্যাটা ছিলো এই জায়গাতেই।

মারিও বালোতেল্লি যখন ১৭,১৮ কিংবা ১৯, ২০ বছর বয়সের যুবক ছিলেন তখন তাকে রক্ষা করাটা স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু যখন সে ২২ বছর কিংবা সেই সময়টা পার করে আসছিলো তখনই লোকজন তাকে রক্ষা করেছে। পরবর্তীতে যখন সে এই সমস্যা গুলোর মুখোমুখি হয়েছে তখন তিনি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। ম্যানচেস্টার সিটিতে থাকাকালে কোচ রবার্তো মানচিনির সাথেও হাতাহাতির ঘটনায় জড়ান। এর কারণেই ফুটবল নিয়ে মনযোগী হতে পারেননি এবং নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন। কোন ক্লাব চায় – এমন ঝামেলাপূর্ণ একজনকে দলের সাথে রাখতে!

বালোতেল্লি একজন প্রতিভাবন ফুটবলা। সে যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এগিয়ে যেতে পারতো তাহলে সে হতে পারতো বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আলোচনার তৈরি করে সম্পূর্ন মনযোগ ওইদিকে সরিয়ে ফেলে নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারকে শেষ করেছেন বালোতেল্লি। এক সময় ইন্টার মিলান, এসি মিলান, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার সিটির মত ক্লাবে খেলা প্রতিভাধর খেলোয়াড়টিকে এখন শীর্ষ পর্যায়ের কোনো ক্লাব আর দলে নেয় না। তিনি নামতে নামতে নেমে গেছেন সিরি ‘বি’-তে। অথচ, বয়স মাত্র ৩০!

শেষমেশ তাঁকে নিয়ে কেবল একটা কথাই বলা যায়, বালোতেল্লি আদৌ আর ‘ভালো’তেল্লি হতে পারলেন না।

 

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link