লর্ডস ২০০৩: দ্য স্মিথ অ্যান্ড এনটিনি শো

টেরাকোটা সদৃশ প্যাভিলিয়ন, বিখ্যাত ফাইভ মিনিট বেল, সবুজ প্রান্তর, সাথে শত বছরের ইতিহাস আর সহস্র মুহূর্ত। ইতিহাস বা ঐতিহ্যগত, যেভাবেই বলেন না কেন লর্ডসের মাটি অন্য যে কোনো ক্রিকেট স্টেডিয়ামের চেয়ে ভিন্ন। সেঞ্চুরি বা পাঁচ উইকেটের জন্য এখানকার অনার্স বোর্ড যেমন সমাদৃত তেমনি ক্রিকেট ইতিহাসের শত শত রথী মহারথীদের পদচ্ছাপে এই স্টেডিয়ামকে করে তুলেছে আরও অনন্য।

টেরাকোটা সদৃশ প্যাভিলিয়ন, বিখ্যাত ফাইভ মিনিট বেল, সবুজ প্রান্তর, সাথে শত বছরের ইতিহাস আর সহস্র মুহূর্ত। ইতিহাস বা ঐতিহ্যগত, যেভাবেই বলেন না কেন লর্ডসের মাটি অন্য যে কোনো ক্রিকেট স্টেডিয়ামের চেয়ে ভিন্ন। সেঞ্চুরি বা পাঁচ উইকেটের জন্য এখানকার অনার্স বোর্ড যেমন সমাদৃত তেমনি ক্রিকেট ইতিহাসের শত শত রথী মহারথীদের পদচ্ছাপে এই স্টেডিয়ামকে করে তুলেছে আরও অনন্য। 

লর্ডস দিয়ে যেহেতু প্রারম্ভিকা শুরু করেছি, তাই লেখা জুড়েও থাকবে লর্ডসের ছোঁয়া। লর্ডসের মৃত্তিকায় লাল বল ছুঁড়ে ৫ উইকেট নেওয়া কিংবা লর্ডসের মাটিতে উইলো দিয়ে ব্যাটারের শতক উদযাপন – সব কীর্তিই কাব্য গাঁথার মতো স্থায়ী কালিতে ঠাঁই পেয়েছে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে। সেসব ৫ উইকেট কিংবা সেঞ্চুরি লর্ডসের ইতিহাসে অমর। অমর এমন কাব্য গাঁথাগুলো তো আর এক কলেবরে লেখা সম্ভব না।

আপাতত, এই শতাব্দীতে হওয়া একটি ম্যাচের গল্প বলা যেতে পারে। যে গল্পে লুকিয়ে ছিল সেঞ্চুরি পেড়িয়ে ডাবল সেঞ্চুরির মাহাত্ম্য, বোলার হিসেবে দুই ইনিংসেই ৫ উইকেট নেওয়ার দৌরাত্ম্য আর ঐতিহাসিক এক ম্যাচ জয়ের উন্মত্ততা।  

সালটা ২০০৩। লর্ডসের ডেরায় ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার মহারণ। এ ম্যাচ দিয়েই ইংল্যান্ডের হয়ে অধিনায়কত্বের অভিষেক ঘটে মাইকেল ভনের। অবশ্য অধিনায়কত্বের অভিষেকে টস ভাগ্যটা আর সুপ্রসন্ন হয়নি ভনের। টসে হেরে প্রথমে ইংল্যান্ডকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় গ্রায়েম স্মিথের দক্ষিণ আফ্রিকা। 

কে জানে! টস ভাগ্যই কিনা ইংল্যান্ডকে সেদিন জানান দিচ্ছিল কতটা হতশ্রী পরিস্থিতি তাদের সামনে আসছে। টপ অর্ডার থেকে শুরু করে মিডল অর্ডার, ইংলিশ কোনো ব্যাটারই যেন সেদিন শন পোলক-মাখায়া এনটিনিদের পেস আক্রমণ সামলাতে পারছিলেন না। ৯৬ রানের মাঝেই তারা হারিয়ে ফেলে ৬ উইকেট।

শেষমেশ ড্যারেন গফ আর জিমি অ্যান্ডারসনের কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তারা। তারপরও রানসংখ্যা ২০০ তে নিতে পারেনি ইংলিশরা।  স্কোরবোর্ডে তারা তুলেছিল ১৭৩ রান। মাখায়া এনটিনি একাই সেদিন নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। একই সাথে লর্ডসের অনার্স বোর্ডেও নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেন তিনি। 

এ তো ছিল মাখায়া এনটিনির শুরুর চমক। ব্যাটিংয়ে এসে অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ যেন ইংলিশ বোলারদের জন্য শক্ত দেয়াল হয়ে আবির্ভূত হলেন। ৫০ পেড়িয়ে সেঞ্চুরি, সেঞ্চুরি থেকে ডাবল সেঞ্চুরি। তারপরও বিরাম নেই। বিরামহীন ভাবে ব্যাট করে গেলেন। যেন কোনো তাড়া নেই। ইংলিশ বোলারদের যম হয়ে টিকে থাকলেন ক্রিজে। বলের পর বল খেলছেন। আর ইংলিশ ফিল্ডারদের নিরস মুখভঙ্গি উপভোগ করছিলেন।

৫৭৪ মিনিট অর্থাৎ ৯ ঘন্টা ৩৪ মিনিট পর জিমি অ্যান্ডারসনের বলে যখন তিনি বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে ফিরছেন ততক্ষণে ৭৩ বছর আগে গড়া একটি রেকর্ড ভেঙ্গে গিয়েছে। ১৯৩০ সালে ২৫৪ রানের ইনিংস খেলে নন ইংলিশ ক্রিকেটার হিসেবে লর্ডসের মাটিতে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ড গড়েছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। ৭৩ বছর পরে এসে, ২৫৯ রানের ইনিংস খেলে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সেই রেকর্ডটিই ভাঙেন গ্রায়েম স্মিথ। 

গ্রায়ের স্মিথের ডাবল সেঞ্চুরি ছাড়াও সে ইনিংসে ১০৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন গ্যারি কার্স্টেন। এ ছাড়া বোয়েটা ডিপেনিয়ার আর মার্ক বাউচার করেছিলেন হাফ সেঞ্চুরি। ১ ডাবল, ১ সেঞ্চুরি আর ২ হাফ সেঞ্চুরিতে তাই রান পাহাড়েও বসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। স্কোরবোর্ডে ৬৮২/৬ থাকতেই ইনিংস ঘোষণা করেন প্রোটিয়া অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। 

প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের ১৭৩ রানের বিপরীতে দক্ষিণ আফ্রিকার ৬৮২ রান। অনেকটা ইনিংস হারের শঙ্কাতেই দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল ইংল্যান্ড। অবশ্য ইনিংস হার এড়াতে ভালই ব্যাটিং করছিল ইংলিশ ব্যাটাররা। তবে শেষ পর্যন্ত আবারও মাখায়া এনটিনির তোপে অসহায় হয়ে পড়ে তাদের ব্যাটিং লাইন আপ। প্রথম ইনিংসের পর এ ইনিংসে ৫ উইকেট নেন এনটিনি৷

আর অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের ১৪২ রানের ইনিংসে ভর করে ইংলিশরা ৪০০ পেড়িয়েছিল ঠিকই কিন্তু ফলো অন থেকে সে সংগ্রহ ছিল আরও ৯২ রান দূরে। দলের শেষ ব্যাটার হিসেবে ফ্লিনটফ আউট হয়ে গেলে ইনিংস ও ৯২ রানের জয় নিশ্চিত হয়ে যায় প্রোটিয়াদের। আর এর মধ্য দিয়ে লর্ডসের মাটিতে প্রথম বারের মতো ইনিংস ব্যবধানে জয় পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। 

দুই ইনিংসেই ৫ উইকেট নেওয়া মাখায়া এনটিনি আর ২৫৯ রানের ইনিংস খেলা গ্রায়েম স্মিথ, দুজনকেই সে ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচ ঘোষণা করা হয়। তবে সে সব ছাপিয়ে লর্ডসের মাটিতে সেদিন ইংল্যান্ডকে ইনিংস ব্যবধানে হারানোই উচ্ছ্বাসের উপলক্ষ হয়ে আসে প্রোটিয়াদের জন্য। লর্ডসে ম্যাচ খেলাই যেখানে গর্বের ব্যাপার সেখানে লর্ডসে ম্যাচ জয়ের মাহাত্ম্য তো আকাশ ছোঁয়া হবেই।

অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকেই দলের এমন হতশ্রী পারফরম্যান্স। শুরুতেই তিক্ততার স্বাদ।  তারপরও এই মাইকেল ভনই ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ছিলেন অন্যতম সফল অধিনায়ক। অধিনায়ক হিসেবে ম্যাচ সংখ্যায় হাফ সেঞ্চুরি করেছেন এমন ইংলিশ অধিনায়কদের মধ্যে জয়ের শতাংশে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক হলেন ভন।

আর ম্যাচ জয়ের সংখ্যায় জো রুটের পরেই তাঁর অবস্থান। জো রুট তাঁর অধিনায়কত্বে ২৭ টি টেস্ট জিতেছেন, আর তাঁর চেয়ে একটি ম্যাচ কম জিতেছেন মাইকেল ভন(২৬ টি)। 

শেষ করছি, সেই লর্ডস দিয়েই। ২০০৩ সালে লর্ডসে ইনিংস ব্যবধানে হারার পর দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে এই মাটিতে কোনো ইনিংস হারের মুখ দেখেনি ইংল্যান্ড। কিন্তু ২০২২ সালে এসে সেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই আবার লর্ডসে ইনিংস ব্যবধানে ম্যাচ হারে ইংল্যান্ড। এবার ইংল্যান্ডের জন্য ২০০৩ এর মাখায়া এনটিনি হিসেবে ধরা দেন কাগিসো রাবাদা। মাখায়া এনটিনি থেকে কাগিসো রাবাদা, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম। অবশ্য এই লর্ডসই তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাঁধিয়ে রাখে তাঁর নিজস্ব মহিমায়। 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...