গতি সিংহাসনের অভূতপূর্ব রাজা

শোয়েব আখতার উইকেট আর গতি ছাপিয়ে ছিলেন এক জীবন্ত এক্সপ্রেশন। তাঁর প্রতিটা ডেলিভারি এক নিখুঁত প্রস্থানে ছড়িয়ে দেওয়া নাটকীয়তা — এক বৈপ্লবিক শক্তি, যা কেবল ক্রিকেটকেই নয়, বিশ্বের সমস্ত রেকর্ডকেই মুছে ফেলে, যার পাশে তার নিজের নামও ছাপিয়ে যায়।

একটা সময় ছিল, যখন ক্রিকেটের আকাশে চন্দ্র বা সূর্য নয়, একটাই রাশি রাজত্ব করত — সেটা হল গতি। আর সেই গতির মহাজগতে, শোয়েব আখতার ছিলেন এক অভূতপূর্ব তারকা। তাঁর গতি ছিল একটা মায়াবী ধুম্রজাল — যা মাঠের প্রতিটি কোণায় এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করত। যে পৃথিবীর রহস্য ভেদ করার কৌশল বিশ্বের কোনো ব্যাটারেরই জানা ছিল না। তাঁর প্রতিটা ডেলিভারি কেবল ক্রিকেটের একেকটি অস্ত্রই ছিল না, ছিল এক ধরনের জাদুর কাঠি, যা মাঠে ঝড়ের মতো প্রবাহিত হতো, আর সেই ঝড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত প্রতিপক্ষের বুক।

শোয়েব আখতার ছিলেন সেই গতি নাটকের প্রধান চরিত্র —  সাড়ে তিন শতাব্দীজুড়ে চলা গতির মহাকাব্যের অমর নায়ক। আর তাঁর খেলা? তা ছিল এক আকাশচুম্বী গতির মঞ্চ, যেখানে সময় আর স্থান সব কিছুই ছিল এক মুঠোয়।

কাট টু ২০০২ সালের ২১ এপ্রিল। করাচির গরমে, শোয়েব আখতার তার ভূপতিত বলগুলো দিয়ে যেন একে একে ভেঙে দিচ্ছিলেন সীমানা—হতাশ নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের জন্য ছিল এক বিভীষিকা। ৯-১-১৬-৬, ইকোনমি রেট ১.৭৭! আর বলের গতি? প্রায় ১৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা! স্টাম্প গুড়িয়ে দিলেন আন্দ্রে অ্যাডামসের, যেন তার বল শুধু রান নয়, ইতিহাস তৈরি করছে।

শোয়েব আখতার মানেই গতি। ক্রিকেটের গতি সিংহাসনের অভূতপূর্ব রাজা তিনি। তার জন্য খেলা মানে ছিল একটা বিশাল রেস, যেখানে তিনি নিজের রেকর্ড ভাঙতেন প্রতি মুহূর্তে। ‘ফাস্ট থেকে ফাস্টেস্ট বোলিং’ ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য — আর তা তিনি প্রতিটা ডেলিভারিতেই প্রমাণ করতে মরিয়া ছিলেন। শোয়েব এমন এক বিস্ফোরণ, যে বিস্ফোরণের সামনে ইডেন গার্ডেন্সে কোনো জবাব ছিল না শচীন টেন্ডুলকার কিংবা রাহুল দ্রাবিড়ের।

কাট টু ২০০৩ বিশ্বকাপ। এবার তিনি ব্যাটার।  ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শোয়েবের ১৬ বলে ৪৩ রানের বিস্ফোরণ ছিল আরেকটি অভূতপূর্ব মুহূর্ত। তাঁর গোটা জীবনের নাটকীয়তা ও গ্ল্যামারের সেরা উদাহরণও বলা যায় এই ইনিংসকে। ব্যাট হাতে যেন এক ক্ষিপ্র ঝড়, যা পুরো ম্যাচের স্রোত পাল্টে দিয়েছিল, যদিও ফলাফল সে অনুযায়ী না হলেও শোয়েবের আত্মবিশ্বাস সেদিন সপ্তম আকাশ ছুয়ে গিয়েছিল।

শোয়েবের বোলিং ছিল কোনো সীমারেখায় বাঁধা নয়। শারজাহ, ডারবান, মেলবোর্ন—সে মাঠ যেখানে ছুটেছে, সেখানে ক্রিকেটের মহাকাব্য রচনা হয়ে গেছে। তিনি ছিলেন সেই রাজা, যার জন্য ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ নামটা শুধুই পরিচয় নয়, একটা অপ্রতিরোধ্য শাসন।

ক্যারিয়ারের ব্যাপ্তি খুব বড় কখনওই ছিল না শোয়েব আখতারের। পরিসংখ্যানের ছকে তাই তাঁকে ফেলাটা নেহায়েৎই বোকামি। শোয়েব আখতার উইকেট আর গতি ছাপিয়ে ছিলেন এক জীবন্ত এক্সপ্রেশন। তাঁর প্রতিটা ডেলিভারি এক নিখুঁত প্রস্থানে ছড়িয়ে দেওয়া নাটকীয়তা — এক বৈপ্লবিক শক্তি, যা কেবল ক্রিকেটকেই নয়, বিশ্বের সমস্ত রেকর্ডকেই মুছে ফেলে, যার পাশে তার নিজের নামও ছাপিয়ে যায়।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link