‘এখানে গোলাগুলি হচ্ছে, প্লিজ আমাদের বাঁচান’

আমি হ্যাগলি ওভাল ছেড়ে যাচ্ছিলাম, দলের অন্যতম সিনিয়র ক্রিকেটার তামিম ইকবালের কাছ থেকে একটি কল পেয়ে থামতে হলো। তিনি সাহায্যের জন্য আমাকে ডাকছিলেন, ‘এখানে গোলাগুলি হচ্ছে, প্লিজ আমাদের বাঁচান।’ প্রথমে ভাবছিলাম তিনি মজা করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তিনি বারবার কল দিচ্ছিলেন এবং একসময় তাঁর কন্ঠ আতঙ্কে ভাঙা ভাঙা মনে হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, পুলিশ ডেকে আনতে, কারণ তাঁরা যেই মসজিদে যাচ্ছিলেন, সেই মসজিদের ভেতরেই গুলিবর্ষণ করছে কেউ, এবং তাঁরা এর কাছাকাছি আটকা পড়ে গেছেন।

আমার সকালটা শুরু হয়েছিল, কেন উইলিয়ামসন, জেমস ওয়াটলিং, তামিম ইকবাল এবং মুশফিকুর রহিমের ইনজুরির সর্বশেষ আপডেটের খোঁজ শুরু করে। আমার মাথায় ঘুরছিল যে, কাল থেকে শুরু হওয়া টেস্টের দু’দলের একাদশে কারা খেলছে, আর কারা মিস করছে!

এর আট ঘন্টা পরে, আমি ক্রাইস্টচার্চে এক বন্ধুর বাসায় বসে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলাটার অর্থ বোঝার চেষ্টা করছিলাম।

ক্রিকেট আমার মাথা থেকে অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছিল, আমি শুধু চিন্তা করছিলাম, এই খেলোয়াড়দের দেশে থাকা পরিবারের কথা, যারা ঘটনাস্থলের হাজার মাইল দূরে থেকে প্রবল উৎকন্ঠায় সময় কাটিয়েছে। আমি ভাবছিলাম সেই সমস্ত লোকের কথা যারা মসজিদে এসে বেঘোরে প্রাণ হারালো।

ক্রাইস্টচার্চে এখন প্রায় মধ্যরাত। আমি লিখতে বসেছি, কখন কি ঘটেছে তা নোটে তুলে রাখার চেষ্টায়, মগজ যদিও কাজ করছেনা এখনো, তড়পাচ্ছে সেই ভয়াবহতার আঁচে।

আমি শান্ত মানুষ, মাঝেমাঝে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করছি, কিন্তু মানসিক চাপটা তাতে আড়াল করতে পারছিনা। ঘটনাটির সময়কাল হয়তো মাত্র কয়েক মিনিট কিন্তু এটি জীবনমরণের ব্যাপার ছিল।

  • দুপুর একটা

বাংলাদেশ দল হ্যাগলি ওভালে পৌছায় অনুশীলনের জন্য। তখন কিছুটা বৃষ্টিও ছিল সেখানে, কিন্তু তারা শুক্রবারের জুম্মা নামাজ কাছের মসজিদে আদায় করে, তারপর প্র্যাকটিস সেশন শুরু করার পরিকল্পনা করে। যদিও লিংকন ইউনিভার্সিটির ইনডোরে প্র্যাকটিস ফ্যাসিলিটি ছিল, কিন্তু সেটি বেশ দূরে বিধায় তাঁরা সেদিকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

  • দুপুর একটা ২৭ মিনিট

বাংলাদেশের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ হ্যাগলি ওভালে ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন। তিনি তাড়া দিচ্ছিলেন, কারণ বেশিরভাগ খেলোয়াড় মসজিদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু তিনি তবু তিনি নয় মিনিট বাড়তি সময় দিয়েছিলেন।

  • দুপুর একটা ৩৫ মিনিট

আমি পার্কিং লটসে ছিলাম, বাংলাদেশের টিমবাসের সাথে এসেছিলাম। সফররত দলের ১৭ জন এসেছেন, যাদের মধ্যে ম্যানেজার খালেদ মাসুদ, কম্পিউটার এনালাইসিস্ট শ্রীনিবাস ও টিম বয় মো: সোহেলও এসেছিলেন।

  • দুপুর একটা ৫২ মিনিট

আমি হ্যাগলি ওভাল ছেড়ে যাচ্ছিলাম, দলের অন্যতম সিনিয়র ক্রিকেটার তামিম ইকবালের কাছ থেকে একটি কল পেয়ে থামতে হলো। তিনি সাহায্যের জন্য আমাকে ডাকছিলেন, ‘এখানে গোলাগুলি হচ্ছে, প্লিজ আমাদের বাঁচান।’ প্রথমে ভাবছিলাম তিনি মজা করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তিনি বারবার কল দিচ্ছিলেন এবং একসময় তাঁর কন্ঠ আতঙ্কে ভাঙা ভাঙা মনে হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, পুলিশ ডেকে আনতে, কারণ তাঁরা যেই মসজিদে যাচ্ছিলেন, সেই মসজিদের ভেতরেই গুলিবর্ষণ করছে কেউ, এবং তাঁরা এর কাছাকাছি আটকা পড়ে গেছেন।

  • দুপুর একটা ৫৩ মিনিট

কাঁপা পায়ে সেই মসজিদের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম। আমি দুশ্চিন্তা থামাতে পারছিলাম না, আপনি আমাকে বোকা ঠাওরাতে পারেন, যে কিনা নিশ্চিত বিপদ জেনেও একটি টেরর জোনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি জানতাম যে, আমাকে যেতেই হবে। একজন সাংবাদিক হিসেবে, সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে।

আমি মেইন রোডের দিকে দৌড়তে শুরু করি, যখন একজন নারীকে তাঁর গাড়ির দিকে এগোতে দেখি। তিনি আমাকে লিফট লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করেন। আমি তাঁকে তামিমের কথাগুলি বলি, এবং তিনি আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে রাজি হন। ওদিকে আমার সহকর্মী বাংলাদেশি সাংবাদিক মাজহারউদ্দিন অমি (ডেইলি স্টার) ও উৎপল শুভ্রও (প্রখ্যাত সাংবাদিক) আলাদাভাবে একই জায়গায় চলে আসছেন বলে আমাকে জানালেন

  • দুপুর একটা ৫৬ মিনিট

আমরা ডিনস অ্যাভিনিউয়ের মুখটা দেখতে পাচ্ছি, যেখানে মসজিদটি অবস্থিত, পুলিশের গাড়ী জায়গাটা আটকে রেখেছে, তাই আমরা ডিনস এবং রিকারটন এভিনিউয়ের কোনায় পার্কভিউ হোটেলের সামনে চলে যাই। আমি যখন বাংলাদেশ দলের বাসটি দেখতে পাই, তখন মসজিদের দিকে দৌড়াতে শুরু করি। বেশ কয়েকটি পুলিশ গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স দেখলাম। কিছু কৌতূহলী মানুষ এলোপাথারি জড়ো হয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল কি হয়েছিল এখানে, আমিও পরিস্কার বুঝিনি আসলে কি ঘটেছে।

কিন্তু আমি ডানপাশে একটি মোটেলের মেইনগেটের দিকে তাকাতেই স্থির হয়ে গেলাম, একটা মানুষ উপুড় হয়ে পড়েছিল রাস্তায়, সর্বত্র রক্ত ​ছড়িয়ে।

  • দুপুর দু’টা

আমার কাছেই একজন মানুষ আমার বাহু ধরে কাঁদছিল। তাঁর শার্টে ভালভাবেই রক্তের দাগ বোঝা যাচ্ছিল। আশেপাশের লোকজনেরা একে অন্যকে পালাতে সাহায্য করছে, তাঁরা তাঁকেও পালিয়ে যেতে চেঁচাচ্ছিল। আমি টিমবাস থেকে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের লাইন ধরে বের হতে দেখে দ্রুত সেদিকে হাটতে থাকি। রাস্তা পার করে যখন আমি তাঁদের সাথে চলে আসি, তখন এবাদত হোসেন আমার হাত ধরে তাঁদের সাথে যাবার জন্য বলেন। এতক্ষণেও আমি এখনও কি ঘটেছে তাঁর স্পষ্ট কোণো ধারণা পাইনি, ক্রিকেট দল এই হামলার টার্গেট ছিল কিনা তাও আমি বুঝতে পারছিলাম না।

  • দুপুর দু’টা দুই মিনিট

খেলোয়াড়রা এখন হ্যাগলি পার্কের পাশে, এবং একজনকে থামিয়ে রাস্তা জিজ্ঞেস করছে। গ্রাউন্ড থেকে তাঁদের হাটার দূরত্ব ১৫ মিনিটের ছিল। খেলোয়াড়রা পার্কে  প্রবেশ করা মাত্র অনেকটা দৌড়াতে থাকে আতঙ্কে, যদিও সেই ভদ্রলোক তাঁদের দৌড়াতে নিষেধ করে জোরে হাটতে বলেছিলেন।

  • দুপুর দু’টা চার মিনিট

তামিমের সাথে হাঁটছি এবং আমি খেয়াল করি খেলোয়াড়রা তাল রাখতে না পেরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাটছে, কেউ কেউ বেশ পেছনে। আমি সোহেলকে বলি, সবাইকে একসাথে নিয়েই হাটতে হবে। এটা বেশ দুরূহ ব্যাপার ছিল, কিন্তু আমরা একসাথে থাকতে গতি কমিয়ে হাটতে থাকি।

দূরত্ব ১ কিলোমিটারেরও কম ছিল, কিন্তু এটি মনে হয় আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম মিনিট ছিল। খেলোয়াড়রা যা দেখেছেন তা নিয়েই কথা বলছিলেন, এবং তা ছিল রক্ত আর  লাশ। একজন সিনিয়র খেলোয়াড় আমাকে ধরে ভেঙে পড়েন। আমি তাকে কিছুই বলতে পারছিলাম না।

  • দুপুর দু’টা আট মিনিট

আমরা হ্যাগলি ওভালে পৌঁছেছি এবং ভিতরে যাই সবাই। খেলোয়াড়দেরকে অথোরিটি ড্রেসিং রুমের ভিতরে নিয়ে যায়, যেখানে তারা শেষ পর্যন্ত বসেছিল। তাঁরা সবাই একপ্রকার কাঁপছিলেন।

  • দুপুর দু’টা ১০ মিনিট

আমরা হ্যাডলি প্যাভিলিয়নে যাই,  যেখানে গ্রাউন্ড স্টাফ, এনজেডসির স্টাফদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল।

  • দুপুর পৌনে তিনটা

দুই ক্রিকেট বোর্ডের জরুরী আলাপের পর তাঁদেরকে ক্যাথিড্রাল রোডের হোটেলে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁদেরকে দ্রুত সেখানে আশ্রয় নিতে বলা হয়। সাংবাদিকরা এখানেই ছিলেন।

  • দুপুর সাড়ে তিনটা

হ্যাগলি ওভালে থাকা অবস্থায়, মসজিদের কাছে যেখানে কিছুক্ষণ আগেও আমি ছিলাম, সেখানে পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্সের বহর ঘুরে বেড়াতে দেখছিলাম।

  • বিকাল পাঁচটা

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এবং আইসিসির সাথে আলোচনার পর নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট (এনজেডসি) সফর বন্ধ ঘোষণা করে।

  • সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা

আমরা অবশেষে গ্রাউন্ড ছাড়ার অনুমতি পেলাম, এবং আমরা হোটেলে দলের কাছে রওনা হই।

  • সন্ধ্যা সাতটা

চুপচাপ হয়ে যাওয়া ক্রাইস্টচার্চ শহরের কেন্দ্রস্থল আমরা অতিক্রম করি। আমরা তিনটি গাড়িতে হোটেলে পৌঁছালাম। ম্যানেজার খালেদ মাসুদ আমাদেরকে দলের কক্ষে নিয়ে গিয়ে সেখানে কি ঘটেছিল তার বিস্তারিত বিবৃতি দিয়েছেন এবং দলের পরবর্তী প্ল্যান নিয়ে কথা বলছেন।

  • সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা

আমরা যেখানে ফোন চার্জ করি সেই রুমে যাচ্ছি, তামিম ইকবাল আমাদের সাথে যোগ দিলেন। তিনি এখনো কাঁপছেন, আমি তাঁকে তখন বিশ্বাস না করার জন্য ক্ষমা চাই। তিনি সহজ করবার জন্য আমাকে পিঠে খোঁচা দেন এবং হেসে ফেলেন।

  • রাত আটটা

ম্যানেজার খালেদ মাসুদের আমন্ত্রণে ডিনারে আসি। তারপরে আমরা আমাদের নিজের হোটেলে চলে যাই। সেন্ট প্যাট্রিকস ডে উপলক্ষে সাপ্তাহিক ছুটির শুরুর দিনে ক্রাইস্টচার্চকে একেবারেই শান্ত লাগছে। এটি একটি ভয়াল শুক্রবার ছিল সবার জন্য। এই শহরটি হয়তো আর আগের মত হতে পারবেনা।

  • রাত ১০ টা

বন্ধুর বাড়িতে উঠলাম, ডিনারের আমন্ত্রণে। যদিও পেটে কোন ক্ষুধা নেই, দুজনে আলাপন হলো একটু। মিনিটগুলি ফোনে সেই অভিশপ্ত খবরের আপডেট পেতে পেতে কেটে যাচ্ছিল – আরো একজন চলে গেলো, মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়লো একজন।

____________________

– ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে `There’s shooting here, please save us’ শিরোনামে লেখাটি লিখেছিলেন গনমাধ্যমটির বাংলাদেশ করেসপনডেন্ট মোহাম্মদ ইশাম। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ টেস্ট কভার করার জন্য তিনি ক্রাইস্টচার্চেই অবস্থান করছিলেন। সেই ঘটনার স্মৃতি বুকে নিয়ে দু’বছর বাদে আবারো সেই নিউজিল্যান্ড সফরে গেছে বাংলাদেশ দল

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...