দারুণ একটা ওপেনিং জুটি ভেঙে গেল। এরপর অধিনায়ক মুমিনুল ও নাজমুল হোসেন শান্তও প্যাভিলিয়নের পথ ধরলেন দ্রুতই। টানা তিন উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন একটু কোণঠাসা। এরই মাঝে গরমের কাছে হার মেনে সেঞ্চুরি করা তামিম রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে আসলেন। ছয় নাম্বারে ব্যাট করতে নামা লিটনের কাঁধে তখন বড় দায়িত্ব। দল চাপে, মুশফিককে নিয়ে বড় স্কোর করা চাই, ধরে খেলা চাই। তবে লিটনের ব্যাট এসব থোরাই কেয়ার করে। লিটন খেললেন, লিটনের মত করেই।
দলকে চাপমুক্ত করার জন্য বাড়তি কিছু করতে চাননি। আবার টিকে থাকতে হবে বলে খারাপ বলগুলোকেও ছেড়ে কথা বলেননি। শুরুতে নিজের সময় নিয়েছেন, উইকেটের চরিত্র বুঝেছেন, নিজেকে বাইশ গজে থিতু করেছেন। এরপর বরাবরের মতই দ্য ক্ল্যাসিকাল লিটন, দ্য আর্টিস্ট লিটন কুমার দাস।
লিটন দাসকে নিয়ে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে অনেক আগে থেকেই। টেস্ট ক্রিকেটে লিটনের অভিষেকের দিন ক্রিকেট কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক নতুন তারকার যাত্রা শুরু হচ্ছে। মাশরাফি বিন মর্তুজা ফতুল্লায় ছুটে গিয়েছিলেন ছেলেটার ব্যাটিং দেখতে। লিটন হতাশ করেননি। প্রায়ই জানান দিয়েছেন ব্যাট হাতে নিজের দিনে লিটন বিশ্বসেরাদের একজন।
তবে সমস্যা হচ্ছিল লিটনের ধারাবাহিকতা নিয়ে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে অসাধারণ ইনিংস গুলো খেলছিলেন সেগুলো এসেছে বিচ্ছিন্ন ভাবে। তবে গত এক বছরে আসলে লিটন নিজের প্রতিভার পুরোটা মাঠে ছড়িয়ে দিতে পারছেন। লিটনের এই বিশাল পরিবর্তনের অন্যতম কারণ তাঁর মনস্তাত্বিক বিপ্লব।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকে লিটনের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ইনিংসের শুরুটা। নিজের প্রথম ১৫-২০ রান করতে লিটন বেশ সেকি থাকেন। তবুও তিনি ওই সময়টায় এতদিন জোর করে বাউন্ডারি মারার চেষ্টা করেছেন। তবে এখন আর লিটন সেটা করছেন না। নিজেকে ক্রিজে সময় দেন। কারণ তিনি জানেন একবার সেট হয়ে গেলে লিটন বাইশ গজে যেকোন কিছু করতে পারেন। লিটন আসলে এখন নিজের উইকেটের মূল্যটা বুঝতে পেরেছেন।
আর এই মনস্তাত্বিক পরিবর্তনটাই তাঁর বিশ্বসেরাদের একজন হওয়ার দৌড়ে নিয়ে এসেছে। লিটন বিশ্বসেরাদের একজন হতে পারেন এটা শুধু বলার জন্য বলা নয়। লিটনের প্রতিভা নিয়ে কারো মনেই প্রশ্ন ছিল না, তবে শঙ্কা ছিল লিটন এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারবেন কিনা।
গত একবছরে লিটন প্রমাণ করেছেন যেকোন পরিস্থিতিতে, যেকোন কন্ডিশনে, যেকোন প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই তিনি রান করতে পারেন। এই লিটন রান করেছেন ঢাকার মন্থর উইকেটে, আবার ক্রাইস্ট চার্চের ফাস্ট উইকেটে, একইরকম সাবলীল চট্টগ্রামের স্পোর্টিং উইকেটেও।
গত ছয় মাসেই তুলে নিয়েছেন ক্যারিয়ারের দুইটি সেঞ্চুরি। এছাড়া এই সময়ে তিনটি হাফ সেঞ্চুরির দেখাও পেয়েছেন। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে গত একবছরে তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা। এছাড়া ২০২২ সালে টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যানও লিটন দাস। এই বছর এখন পর্যন্ত টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান এসেছে উসমান খাজার ব্যাট থেকে। আর পাঁচ টেস্ট খেলতে নামা লিটনের ব্যাট থেকে এসেছে ৪৫.৬২ গড়ে ৩৬৫ রান। এই সময়ে একটি সেঞ্চুরি ও দুইটি হাফ সেঞ্চুরর দেখাও পেয়েছেন লিটন।
সবমিলিয়ে শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটে নয়, বিশ্বক্রিকেটেই সেরাদের তালিকায় নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন লিটন। বিশ্বসেরা হবার সবকিছুই আছে এই ব্যাটসম্যানের মাঝে। এছাড়া বাংলাদেশের ক্রিকেটকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে পারেন লিটনরাই।
যদিও নিজের ইনিংসগুলোকে খুব বেশি বড় করার সুযোগ পাচ্ছেন না লিটন। টেস্টে তিনি ব্যাট করছেন ছয় নাম্বারে। ফলে অধিকাংশ সময়েই খুব বেশি সময় পান না। তবুও ব্যাট হাতে এমন অনন্য সব কীর্তি গড়ে চলেছেন। আবার নিজের ভুলেও কখনো কখনো তাঁর ইনিংসগুলো পূর্ণতা পাচ্ছেনা। আজ যেমন ৮৮ রান করেই ফিরে গেলেন সাঝঘরে। এই সমস্যা গুলো দূর হলে হয়তো আরো অনেক বড় ইনিংস দেখা যাবে তাঁর ব্যাট থেকে।