ক্রীড়াজগতে এই জিনিসটা হরহামেশাই ঘটে। একযুগের সেরা কোনো সময় নিজের ব্যাটনটা তুলে দেন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। লিওনেল মেসির বেলায় ঘটেছিল এমনটা, স্বয়ং রোনালদিনহো মেনে নিয়েছিলেন তার শ্রেষ্ঠত্ব। শচীন টেন্ডুলকার উইলোটা সামনে এগিয়ে নেবার ভার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বিরাট কোহলির হাতে। তেমনি আজ থেকে দুই যুগ আগে টেনিসপ্রেমীরা সাক্ষী হয়েছিল অভূতপূর্ব এক ঘটনার সাক্ষী।
পিট ‘পিস্তল’ সাম্প্রাস সেদিন হেরে গিয়েছিলেন বিশ বছর বয়সী এক সুইস তরুণের কাছে। এক প্রজন্মের হাত থেকে নেতৃত্বের পালাবদলটা ঘটে গিয়েছিল সেদিনই। সময় গড়িয়েছে সুইস সেই তরুণ আরো পরিপক্ব হয়েছেন, ক্রমেই হয়েছেন টেনিস কোর্টের মহিরুহ। তিনি রজার ফেদেরার, টেনিস ব্যাটের জাদুকর।
ফেদেরার সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ডস্লাম জয়ী নন, অলিম্পিকেও সিংগেলসে সোনা জিততে পারেননি। তবুও ফেদেরারকে সেরা মানতে একবারও দ্বিধা করেন না কেউ। তার মতো সুন্দর করে খেলাটাকে যে খেলতে পারেননি কেউই।
তার হাতে টেনিস ব্যাটটা ঘুরে বেড়াত শিল্পীর তুলির মতো, যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জন্ম দিচ্ছে অমর সব শিল্পকর্ম। কোর্টে তার নড়াচড়াতেও যেন ছিল শিল্পের ছোঁয়া, প্রতিটা পদক্ষেপে মিশে ছিল অপরিসীম মুগ্ধতা। কিংবদন্তি জিমি কর্নস একবার বলেছিলেন, ‘হয় তুমি একজন হার্ডকোর্ট স্পেশালিস্ট, না হয় ক্লে কোর্ট কিংবা গ্রাসকোর্ট স্পেশালিট, অথবা তুমিই রজার ফেদেরার!’
জন ম্যাকেনরোর ভাষায় তিনিই টেনিস ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাবান খেলোয়াড়। কিন্তু ব্যক্তিগত খেলায় কখনোই কেবল প্রতিভা দিয়ে জেতা যায় না। প্রতিভার সাথে পরিশ্রম আর একাগ্রতার সম্মিলনেই গড়ে উঠে একজন দিগ্বিজয়ী তারকা। বদমেজাজ, খামখেয়ালীপনা সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনতে কেবল জায়গা করে নেয়া যায় মানুষের মনে। দুই যুগের বেশি সময় ধরে সেই কাজটা নিয়মিতই করে গেছেন ফেদেরার।
২০০৩ সালে প্রথম সুইস হিসেবে গ্ল্যান্ডস্লাম জেতার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ইউএস ওপেন, উইম্বলডন, অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের রাজ্যপাট বুঝে নেন খুব দ্রুতই। কিন্তু কিছুতেই ক্লে কোর্টের শিরোপাটা নাগালে আসছিলো না। কারণ সেখানে এসে গেছেন লাল কোর্টের ঈশ্বর, রাফা নাদাল। ক্লে কোর্টের ঈশ্বর কিংবা রাজাধিরাজ যাই বলুন, সবকিছু এসে থামবে নাদালেই। কিন্তু কথায় আছে চেষ্টায় মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। ফেদেরারের চেষ্টাও বৃথা গেল না, ২০০৯ সালে শিরোপা জিতে দূর করেছিলেন ক্লে কোর্টের জুজু।
তাঁর আগমণের পূর্বে সবার ধারণা ছিল টেনিস বুঝি কেবলই শক্তির খেলা। সবার সেই ভুল ভেঙে দেন তিনি, ফোরহ্যান্ড কিংবা ব্যাকহ্যান্ড দুই ধরনের শটই এমনভাবে খেলতেন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ও মুগ্ধ হয়ে যেতেন। তার সিঙ্গেল ব্যাকহ্যান্ড শটকে হেনরি ক্লে বলেছিলেন, ‘পোয়েট্রি অব টেনিস।’
টেনিসে নাকি ত্রিশের কোটা পেরোতেই সবাই বুড়িয়ে যান। একসময় ফেদেরারকে দেখেও সবাই তাই ভেবেছিলেন। চারিদিকে রব উঠেছিল ফুরিয়ে গেছেন ফেদেরার বলে। কিন্তু সাধারণের নিয়ম অতিমানবের বেলায় খাটবে কেন। ফেদেরারও তাই ফিরেছিলেন, ৩৬ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাফা নাদালকে হারিয়ে জিতেছিলেন নিজের ১৮ তম গ্র্যান্ডস্লাম। লিখেছিলেন ফিনিক্স পাখির ন্যায় ঘুরে দাঁড়ানোর সেই গল্পের পুনরাবৃত্তি।
‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’ প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়মের বাইরে কেউ নয়। তবু মনটা ভারাক্রান্ত হয়, বুকের গভীরে কোথাও ঝড়ের ঝাপটা ঠিক বুঝতে পারি। একদিন দুয়ারে এসে হাজির হয় বিদায়বেলা, গত কয়েক মাসেই বুঝতে পারছিলেন শরীরটা আর সায় দিচ্ছে না।
হাঁটুর ইনজুরিটাও ভোগাচ্ছে বেশ। তাই দেরি করলেন না, জানিয়ে দিলেন বিদায়। ভাঙাগড়ায় খেলায় হয়তো নতুন নতুন রেকর্ড হবে, পুরনো স্মৃতিতে ধুলো জমে হারিয়ে যাবেন অনেকে। কিন্তু তখনো মনের মণিকোঠায় অম্লান হয়ে থাকবেন রজার ফেদেরার, পুরনো ওয়াইনের মতো সুমিষ্ট হয়ে।