পাকিস্তানকে বোঝার সাধ্য কার!

পাকিস্তানের বিশ্বকাপ যাত্রাটাও কিন্তু কম ম্যাজিকাল নয়। কতশত পরিকল্পনা। কতশত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তবুও তো কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের ছিল না কোন দেখা।

চারিদিকে শুনশান নিরবতা। বাজে রকম পরাজয়ের একটা তীব্র হাওয়া বয়ে বেড়াচ্ছে। ফিস ফিস করে গুঞ্জন ছড়াচ্ছে সে বাতাসে, ‘পাকিস্তান দল বাদ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে’। সবকিছুই তখন সম্ভব, কেবল পাকিস্তানের সেমিফাইনালে যাওয়া বাদে। কি অদ্ভুতরকমভাবে সব হয়ে গেল। ক্রিকেটটা ঠিক এখানেই ম্যাজিকাল!

তবে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ যাত্রাটাও কিন্তু কম ম্যাজিকাল নয়। কতশত পরিকল্পনা। কতশত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তবুও তো কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের ছিল না কোন দেখা। সবচেয়ে চিন্তার কারণ ছিল তাদের মিডল অর্ডার।

সেই মিডল অর্ডারের সমাধান খুঁজতে পাকিস্তান ইংল্যান্ডের সাথে খেলেছে সাত ম্যাচের সিরিজ। আবার এরপর ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টেও অব্যাহত ছিল মিডেল অর্ডার নিয়ে পর্যালোচনা। তবুও সঠিক সমাধান নিয়ে যে পাকিস্তান আসতে পেরেছিল বিশ্বকাপের মহামঞ্চে সেটা বলবার সুযোগ নেই।

যেখানে বিশ্বকাপের আগে অধিকাংশ দলই সর্বোচ্চ ছয়টি দ্বিপাক্ষিক ম্যাচ খেলেছে। সেখানে পাকিস্তানের ম্যাচের সংখ্যা ছিল ১২টি। প্রস্তুতির বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিল না সেটা বলে দেওয়াই যায়। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট জয়ের সুখস্মৃতি নিয়েই পাকিস্তান শুরু করেছিল নিজেদের বিশ্বকাপ অভিযান। তবে মস্তিষ্ক জুড়ে তখন নানান চিন্তাভাবনা। দলের প্রাইম পেসার শাহীন শাহ আফ্রিদি নেই পরিপূর্ণ ছন্দে।

সেসব চিন্তার মাঝেই সুখস্মৃতি সব মলিন হতে শুরু করে। ভারতের কাছে হার দিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপ যাত্রা। ভারত বর্তমান সময়ে অন্যতম শক্তিশালী দল। আর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে বিশ্বকাপের মঞ্চে তো খুব বেশি সুখস্মৃতিও নেই। সে পরাজয়টা হয়ত হজম করা গিয়েছে। তবে জিম্বাবুয়ের সাথে হারটা নিশ্চয়ই মেনে নেওয়ার মত নয়। ১৩১ রানের মামুলি টার্গেটটাও বড্ড কঠিন করে ফেলেছিল পাকিস্তানের ব্যাটাররা। সবাই সেখানে অ্যাংকরিং রোল প্লে করতেই ছিলেন ব্যস্ত।

এমনকি যে ওপেনিং জুটির ভরসাতে পাকিস্তান হাজির হয়েছিল বিশ্বকাপে, সে ওপেনিং জুটিও অজানা কারণে ব্যর্থতার গহীন আধারে হারিয়ে যেতে শুরু করে। প্রচণ্ড বিপাকে পাকিস্তানের অবস্থান টেবিলের তলানিতে।

নেদারল্যান্ডস, জিম্বাবুয়ে গ্রুপে থাকা সত্ত্বেও। সেখান থেকে সেমিফাইনালে যাওয়ার রাস্তাটা ছিল প্রায় অবরুদ্ধ। তাছাড়া পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ বড্ড নিস্তেজ ঠেকছিল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে স্বস্তির জয়ের পরও। বারুদের অভাবটা স্পষ্ট।

একজন সুরিয়াকুমার যাদব হয়ত সবার দলে থাকে না। কিন্তু তাঁর আশেপাশের কেউ একজন তো নিশ্চয়ই সবাই চায় তাঁর দলে থাকুক। তবে পাকিস্তানের সে ঠিকানা খুঁজে পেতে সময় লেগে যায় বড্ড বেশি। তবুও ফখর জামানের ইনজুরির বদৌলতে সে সমাধানটা খুঁজে পায় বাবর আজমের দল। প্রচণ্ড তাপদাহে এক পসলা বৃষ্টি হয়েই আগমন ঘটে মোহাম্মদ হারিসের। দক্ষিণ আফ্রিকার মত শক্ত প্রতিপক্ষের বিপক্ষে একেবারে আনকোড়া এক খেলোয়াড়কে বাজিয়ে দেখতেই হল পাকিস্তানকে।

হারিস সফলও হলেন। পুরো টুর্নামেন্টে পাওয়ার প্লে-তে পাকিস্তান একটি ছক্কা হাঁকিয়েছিল হারিসের অন্তর্ভুক্তির আগে। আর হারিস সেদিন এনরিচ নর্কিয়া, কাগিসো রাবাদাদের বিপক্ষে তিনখানা ছক্কা হাঁকিয়ে ফেলেন। যেই বারুদের সন্ধানে ছিল পাকিস্তান সেটা যেন পেয়ে যায় তাঁরা। এরপর বিস্ফোরণ ঘটান ইফতেখার আহমেদ ও শাদাব খান। তাদের অনবদ্য জুটি কঠিন জয়টাকে সহজ করে দেয়। তবে তখনও পাকিস্তানের সেমিফাইনালের যাওয়াটা এক প্রকার অসম্ভবই ছিল বলা চলে।

তবে নিজেদেরকে যখন একটু একটু করে ফিরে পেতে শুরু করেছে পাকিস্তান ঠিক তখন তাদের পক্ষে ভাগ্যও সহায় হতে শুরু করে। পাকিস্তান অবশ্য ধন্যবাদ জানাতে পারে নেদারল্যান্ডসকেও। এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় অঘটনটা তো তারাই ঘটিয়েছে।

পাকিস্তানের সেমিফাইনালের অবরুদ্ধ পথটা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তবে সে পথ ধরে এগোবার কাজটাও পাকিস্তানকেই করতে হত, বাংলাদেশকে হারিয়ে। সেটাও করেছে তাঁরা। সে ম্যাচে মিলেছে আরেক সুসংবাদ।

নিজের চিরায়ত রুপে ফিরেছেন শাহিন শাহ আফ্রিদি। হয়েছেন ম্যাচ সেরা। সেই সাথে মুহাম্মদ হারিস যে যথাযথ এক সমাধান সে প্রমাণটাই রেখেছেন। ব্যাটিং অর্ডারের দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি রানের চাকা দারুণভাবে সচল রাখতেও পেরেছেন তরুণ এই ক্রিকেটার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের খুব বেশি অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি বেশ দারুণ স্বাচ্ছন্দ্যেই ব্যাটিং করছেন নিজের আপন ছন্দে। যে সমাধান পাকিস্তান বিশ্বকাপের আগে হন্যে হয়ে খুঁজেছে। সে সমাধান মিলেছে বিশ্বকাপের শেষভাগে।

এমনটা অবশ্য পাকিস্তানের ক্ষেত্রে নতুন নয়। পাকিস্তান কখনোই বিশ্বকাপ মঞ্চে ধারাবাহিকভাবে একই রকম পারফরমেন্স করে যেতে পারেনি। হয় তাঁরা শুরুতে দারুণ করেছে, কিংবা তাঁরা শেষভাগে নিজেদের নতুন রুপে আবিষ্কার করেন। ১৯৯২ বিশ্বকাপেও ঘটেছিল একই ঘটনা। তবে এবারের বিশ্বকাপটার  শেষ অবধি পৌঁছাতে পারলে তা হবে পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসের অবিস্মরনীয় এক যাত্রা। তেমন একটা ইতিহাস গড়তে নিশ্চয়ই চাইবেন বাবর আজম ও তাঁর সতীর্থরা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...