বজ্রবিদ্যুৎ!
বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য সাফল্যের পালক যোগ হয়েছে ট্র্যাকের রাজার রাজমুকুটে। যতদিন ছিলেন সংখ্যা বাড়িয়ে গিয়েছেন। যাবার আগে নিভৃতে হয়ত বা বলে গিয়েছেন- ‘আমিই স্প্রিন্টের মহারাজ, ব্যাস! কথা শেষ। মানবে না? তীর ছোঁড়া উদযাপন দেখনি? ওই যে বেইজিংয়ে প্রথমবার রেকর্ড করেছিলাম। সেটা লন্ডনেও ছিল। ৯.৬৩ সংখ্যাতত্ত্বের পর, রিওতে’ও অব্যাহত। জানি তোমরা মানবে। ভালোবাসো যে আমায়।’
একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক – আমাদের কাছে ১০ সেকেন্ডের মূল্য কতখানি? অথবা ২০ সেকেন্ড? উত্তর হচ্ছে – মূল্যহীন! দশ বিশ সেকেন্ড একদম মামুলি!
নেট সার্ভারে প্রব্লেম হলে ফেসবুক লগ ইন দিতেই তো আরো বেশি সময় লাগে। অথচ এই ১০/২০ সেকেন্ডেই জ্যামাইকার এক কালো সম্রাট কতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। অমরত্বের দ্বারে নিজের পদচিহ্ন এঁকে এসেছেন। ২০১২, লন্ডন… ২০১৬, রিও… অভিন্ন পথরেখা ধরে এগিয়েছে বোল্ট এক্সপ্রেস। ইয়েস বোল্ট, যিনি চোখের পলকে অমরত্ব কুড়িয়েছেন!
উসাইন বোল্টের স্বর্ণ মাত্র আটটি। নেই কোন ব্রোঞ্জ, রোপ্য। তারপরেও এই নাম ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ এর ইতিহাসে খোঁদাই হয়ে গিয়েছে অমরত্ব নামক বিশেষ রঙতুলির আঁচড়ে। দর্শকপ্রিয়তায় তিনি অনন্য। তাকে যেমন দর্শকরা কাছে টেনে নিয়েছে তিনিও তেমনি তাদের আলিঙ্গন করতে এতটুকু কার্পণ্য করেননি। যেন দর্শকরা তার দ্বিতীয় ট্র্যাক যেখানে যেতেই হবে। ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এর মোস্ট গ্রেটেস্ট পার্সনের অবশ্য এমনটাই হওয়া উচিত।
দর্শকরা দ্বিতীয় ট্র্যাক। আসলটি ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড, বোল্টের স্থায়ী মালিকানা। অনেকটা ব্যবসায় শিক্ষার সাবজেক্ট ম্যানেজমেন্ট এর একমালিকানা ব্যবসায়ের ন্যায়। লাভ-ক্ষতির পুরো ভোগ নিজের। নিজেই নিজের অধিপতি। বোল্টের বেলায় ক্ষতি বলতে কিছু নেই। না! আছে। একবার আছে। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিক। প্রথমবার অলিম্পিকের ট্র্যাকে আঠারো বছরের স্বপ্নচারী তরুণ।
স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে ২১ সেকেন্ড পরই! পায়ের ইনজুরি নিয়ে দৌঁড়েছেন ঠিকই, ফিনিশিং লাইন টাচ করেছেন হিটে সবার শেষে। ২০০ মিটারে ২১.০৫ সেকেন্ড টাইমিংয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরেছিলেন তবে সে পথ নিভৃতে পাড়ি দেননি। কুড়িয়েছেন স্বপ্ন, জমিয়েছেন অভিজ্ঞতা।
অমরত্ব কি এত সহজলভ্য? আমাদের জন্য হয়ত নয়। কিন্তু বোল্টকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করুন। তিনি হাসবেন। কত সহজেই না অমরত্বকে বাগিয়ে নিয়েছেন! অমরত্ব তাঁর কাছে সম্মোহিত, তার কীর্তে বিমোহিত। প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে তিনবার স্বর্ণজয়।
প্রাচীন গ্রিসে লিওনিদাস নামক এক লোক ছিল যিনি খ্রিস্টপূর্ব ১৬৪ থেকে ১৫২ পর্যন্ত চারটি অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত ইভেন্টে সবচেয়ে বেশি ১২ বার সেরা হওয়ার কীর্তি ছিল তার। লিওনিদাসের ইভেন্টগুলিও বোল্টের মত। ১০০ ও ২০০। সর্বশেষ রিও অলিম্পিকে ডাবল জিতে ব্যক্তিগত ইভেন্টে সেরার পোডিয়ামে বোল্ট দাঁড়িয়েছেন ১৪ বার। মানে লিওনিদাসের রেকর্ড ভেঙে গিয়েছে, প্রায় ২১৭০ বছরের পুরনো রেকর্ড।
ওয়ার্ল্ড রেকর্ড, অলিম্পিক রেকর্ড। নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটো বছর ২০০৮ এবং ২০০৯। শ্রেষ্ঠ দুটো আসর বেইজিংয়ের অলিম্পিক আর বার্লিনের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। বেইজিং মহাযজ্ঞে বিশ্বকে জানান দিয়েছেন ০৪’র সেই কিশোর এখন পরিণত। ১৯.৩০ সেকেন্ডে ২০০ মিটারের মিশন শেষ করে অলক্ষ্যে কি বলেছিলেন, বহুদূর যেতে চাই?
পরেরবার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ৯.৫৮ সেকেন্ডে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট শেষ করেছেন। একই আসরে ২০০ মিটার শেষ করতে সময় নিয়েছেন ১৯.১৯ সেকেন্ড। রেকর্ডগুলো যদি কেউ ভাঙ্গতে পারত সেটি বোল্ট নিজেই। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ২০১৭ এর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ শেষে অবসর নিয়ে নিয়েছেন। তাই অন্য কেউ কখনো যদি পারে সেই আশাতেই আমাদের থাকতে হবে, প্রতীক্ষার প্রহর গুণে যেতে হবে।
১৯৮৬ সালের ২১ আগস্ট জ্যামাইকায় জন্ম নেওয়া ‘বজ্রবিদ্যুৎ’ বোল্ট বহুবার বলেছেন স্প্রিন্ট থেকে অবসরের পর ফুটবলার হবার বাসনার কথা। স্বপ্ন দেখেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে মাঠ দাঁপানোর। সেটি না হলেও ওল্ড ট্রাফোর্ডে ঠিকই নেমেছেন, ফ্রেন্ডলি ম্যাচে বিশ্ব একাদশের অধিনায়ক হিসেবে। খেলেছেন নরওয়ের ফুটবল ক্লাব স্ট্রমগসেটের হয়ে আরো একটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচে। সেসব ম্যাচে বোল্টের সঙ্গে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জার্সি নাম্বার। ৯.৫৮, বিশ্বরেকর্ডের ট্রেডমার্ক সংখ্যাতেই রাঙিয়েছেন পিঠ।
বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য সাফল্যের পালক যোগ হয়েছে ট্র্যাকের রাজার রাজমুকুটে। যতদিন ছিলেন সংখ্যা বাড়িয়ে গিয়েছেন। যাবার আগে নিভৃতে হয়ত বা বলে গিয়েছেন- ‘আমিই স্প্রিন্টের মহারাজ, ব্যাস! কথা শেষ। মানবে না? তীর ছোঁড়া উদযাপন দেখনি? ওই যে বেইজিংয়ে প্রথমবার রেকর্ড করেছিলাম। সেটা লন্ডনেও ছিল। ৯.৬৩ সংখ্যাতত্ত্বের পর, রিওতে’ও অব্যাহত। জানি তোমরা মানবে। ভালোবাসো যে আমায়।’
ভালোবাসা থেকে ভক্তরাও একটি অনুরোধ জানাতে পারে, অন্যায় অনুরোধ। বৈশ্বিক ক্রীড়া অভিধানের পাতায় একটি সংশোধনীর দাবি – ‘দৌড় ইজ ইক্যুয়াল টু উসাইন সেইন্ট লিও বোল্ট’! এটিকে সমার্থক শব্দ করে বোল্টকে জানিয়ে দেওয়া হোক। রোড টু অমরত্বে নিজের প্রাপ্তির হিসেব কষতে গিয়ে নিশ্চয়ই আপ্লুত হবেন তিনি! আমরাও দেখব ভিন্ন এক বোল্টকে। তার অমরত্বের পথে কত কীই তো অদেখা আমাদের।